• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক টুকরো হাসিতে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – সতেরো

টুকরো হাসি – সতেরো

পরের বাস

দশ মাস দম বন্ধ করে ঘরে থাকার পর জটিলবাবু বাড়ি থেকে পিছলে বেরুলেন। আসল নাম জটিলেশ্বর। বহু বছর অত বড়ো নামে কেউ ডাকে না। স্কুলে নাম লেখাবার সময় হেডমাস্টারমশাই বাবাকে বলেছিলেন, ‘নিখিলেশ্বরবাবু ছেলের নামটা আপনার সঙ্গে মিলিয়ে না রেখে একটু অন্যরকম রাখুন। এর পরে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড এসবে নাম ঠিক করতে বার বার ছোটাছুটি করতে হবে।’
‘সে আমার ছেলের জন্য দরকার হলে আমিই ছুটব। আমার বাবার নাম পরমেশ্বর, ঠাকুরদার নাম অখিলেশ্বর, তার বাবার নাম নাগেশ্বর…’
‘এবার থামুন।’ হেডমাস্টারমশাই থামালেন।
‘তাহলে আমি যা বলছি আপনি তাই রাখুন। আমার কিন্তু দশ পুরুষের নাম মনে আছে। আমি যা বলছি তা না শুনলে আমি বাধ্য হয়ে সব শোনাব। জন্মের সময় ছেলের মাথায় ছোটো একটা জট দেখা গিয়েছিল। এ ঈশ্বরের লীলা খেলা। ওর নাম জটিলেশ্বরই রাখতে হবে।’
হেডমাস্টারমশাই বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে বলে ক্যাশবাবুকে ডাকালেন।
ক্যাশবাবু আসতেই বললেন, ‘এই কেস আমার কাছে পাঠিয়েছেন কেন? নিজেরা সামলাতে পারেন না? আপনি যা করতে হয় করে টাকা জমা নিয়ে নিন।’ হেডমাস্টারমশাইয়ের ধমক খেয়ে ক্যাশবাবু কলম কামড়ে ভজঘট করে নামটা লিখলেন।
বাবা যদি জানত এর পরে আধার কার্ড নামে একটা বিটকেল কিছু আসবে, তা নিয়ে মানছি না মানব না হবে তবে সংক্ষেপে হাবলু গাবলু যা হোক একটা নাম রাখত।
জটিলবাবু ছেলের নাম রাখতে গিয়েছিলেন ভূতেশ্বর।
কথাটা শুনে বাড়িতে প্রবল আন্দোলন। শেষে নাম রাখা হল যশ। যশের ছেলের নাম কি হবে এ নিয়ে আর ভাবেননি। যাই হোক সব রসাতলে যাক। তিনি আর ভেবে কী করবেন।
আধার কার্ড করবার সময় যিনি নামটা লিখেছিলেন তিনি কম্পিউটারে টাল খেয়ে মনে হয় জটিলের বেশি এগোতে পারেননি। তাই ওই কার্ড নিয়ে যে কাজেই যাওয়া হচ্ছে শুধু জটিলতা।
আধার কার্ডের সেই জটিল থেকে জটিলেশ্বর হতে যে কী বেগ পেতে হচ্ছে তা একমাত্র পায়ের চারজোড়া চটিই জানে। আর জানেন তিনি নিজে। স্কুলে ভর্তি হবার সময় যদি প্রতিবাদ করতেন তাহলে এত হ্যাপা হত না। তখন প্রতিবাদ করার রেওয়াজটাই ছিল না।
সেই হাঙ্গামা দশ মাস বাড়ি থেকে না বের হওয়ায় ঝিমিয়ে ছিল। একটা এল আই সি’র টাকা পাওয়া যাবে। সেটা আটকে আছে জটিলেশ্বর আর জটিলের জটিলতায়।
একদিন গিয়ে কাজ হয়নি। সেদিন ওই টেবিলে যিনি বসেন তাঁর আসার দিন নয়। সবাই রোজ আসছে না। যেদিন টিভির খবরে বলল,এখন থেকে অফিসে প্রতিদিন সবাই আসবে। আর কোনো সমস্যা নেই। জটিলবাবুর গিন্নী আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন।
সমস্যা হল জটিলবাবুর। সকালেই গরম ভাতের সঙ্গে গড়ানে ডাল আর আলু চটকে খাইয়ে বের করে দেয়া হল তাঁকে। টাকাটা সংসারে দরকার।
আজও রাস্তায় প্রচুর লোক। আগের দিন বাসে উঠতে যাবেন।কন্ডাক্টার বলল, ‘পরের বাসে আসুন।’ কথাটা শেষ হতেই বাসটা নাগালের বাইরে।
একটা বাস এসে দাঁড়াল। আজও কন্ডাক্টারের মুখে একই কথা।পরের বাসে আসুন।
রিটায়ারের পর কত লোকের পরামর্শ পেয়েছেন। একজন বলেছিল, ‘একটা রুটের বাসের পারমিট বের কর। দেখবি লাভে লাভ। বসে খাবি।’
বাসের পারমিটের কথা বলতেই বিভাসের ছেলের কথা মনে পড়েছিল। এই পারমিট পেতে গিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্ধের ফলে গুলি খেয়ে ছেলেটা অকালে চলে গেল।
আজকাল আর বাসের ব্যবসায় তেমন লাভ নেই। আগে একটা বাস থাকলে সেটা থেকে দশটা হত। এখন এমন অবস্থা থানায় জমা পড়লে একটা টায়ারও গলার মালা হিসেবে পাওয়া যাবে না।
পেট্রোল ডিজেলের দাম যেভাবে হা-ডু-ডু খেলছে তাতে দম থাকার কথা নয়। ড্রাইভার,কন্ডাক্টার, হেল্পারের পয়সা দেয়া। আজ এটা খারাপ কাল সেটা । রাস্তায় পুলিশের চেকিং, সেখানে টাকা দেওয়া। অ্যাক্সিডেন্ট করলে তো কথাই নেই। তখন চোখে সরষে ফুল। বিস্তর হাঙ্গামার শেষ হাতে যা থাকবে তাতে আর বাস মালিক বলা যাবে না। ইউনিয়নের চাঁদা। তোলাবাজকে খুশি রাখা। এত সমস্যার সহজ সমাধান হল, বাস না কেনা। তাই জটিলবাবু আর বাস কেনার কথা ভাবেননি।
এখন কিছু বাস চলছে। যে যেমন পারছে ভাড়া নিচ্ছে। কারও কিচ্ছু বলার নেই। শুধু শোনা যাচ্ছে বৈঠক হবে। তখন ভাড়া ঠিক হবে। কবে যে কী হবে কে জানে!
একজন বলল, ‘দাদা এই বাসটা খাইবার পাস স্টপেজে থামবে?’
‘পরের বাসে আসুন।’
‘এই বাসটা কি উৎসবের মাঠে যাবে?’
‘পরের বাসে আসুন।’
বাসের সামনে একটা মিছিল আটকে আছে। লোকজন চিৎকার করছে। ট্রেন চালানোর বন্দোবস্ত করতে হবে। করতে হবে। ট্রেন চালান হচ্ছে না কার স্বার্থে জবাব চাই।জবাব দাও। খালি আওয়াজ উঠছে, মানছি না মানব না। ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও। পুলিশি অত্যাচার মানছি না। মানব না।
‘দাদা বাসটা যাবে তো?’
‘যাবে বলেই তো বেরিয়েছি।’ কন্ডাক্টার একটা বিড়ি বের করে দেশলাই জ্বালল।
লোকজনকে দেখলে মনে হয় সবাই কথাটা শুনে মেনে নিয়েছে, ‘আমরা আমপানকে তাড়িয়েছি। করোনাকে হারিয়েছি। বহিরাগত সবাইকে তাড়াব। গোহারা হারাব।’এই শুনে মানুষেরা দু’হাত তুলে নাচতে নাচতে বেরিয়ে পড়েছে।
মিছিল কিছুতেই এগোচ্ছে না। পুলিশ আটকে দিয়েছে।
‘এই বাসটা চিড়িয়াখানায় যাবে?’
‘পরের বাসে আসুন।’
জটিলবাবু দেখলেন সবাই কেমন আনন্দে আছে। কত জায়গায় যেতে চাইছে মানুষ। এত মোচ্ছবের আলোর মধ্যে অন্ধকারের মতো তাঁর টাকাটাই নামের জটিলতায় আটকে আছে। আজ যেভাবেই হোক একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি মরীয়া হয়ে ভিড় বাসেই উঠবার জন্য বাসের সামনে যেতেই কন্ডাক্টার বলল, ‘পরের বাসে আসুন।’
মনে হয় লোকজনের মাঝখানে মাথাটা গলিয়ে দিতে পারলেই গোটা শরীরটা ঢুকে যাবে। এই প্রক্রিয়ায় জটিলবাবু নিজেকে বাসের ভিতরে ঠেলে দিতে দিতে কন্ডাক্টারকে বললেন, ‘আমার আর এ জীবনে নিজের বাস হবে না ভাই। আমাকে এই বাসেই যেতে হবে । এটা তো পরের বাস।’
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *