সাপ্তাহিক টুকরো হাসিতে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – ঊনিশ

টুকরো হাসি – ঊনিশ

মান্তুমাসির পিঠেপুলি

দশবছর হতে চলল আমাদের আর মামার বাড়ি যাওয়া হয় না।
আগে শীতকালে আমরা যেতাম মামা বাড়ি। তখন মামাবাড়ির মজাই ছিল আলাদা। সব মজা ছাড়িয়ে আমাদের কাছে যেটা খুব আনন্দের ছিল তা হল পিঠে খাওয়ার।
দাদু ব্যবসার জন্য কলকাতা ছেড়ে দিল্লীতে চলে যাওয়ার পর থেকে মামা বাড়ির আনন্দটাই মাটি। আমার মা আর এক মাসি ছোটো। সবার বড়ো মান্তুমাসি।
বিয়ে করেনি। কেন করেনি এই নিয়ে মা মাসিরা মাঝে মাঝে মান্তুমাসির আড়ালে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে। একবার মান্তুমাসির নজরে পড়েছিল।
রেগে আগুন হয়ে বলেছিল, ‘আমি কি তোদের বাপের টাকায় খাই? আমি আমার বাপের টাকায় খাই। তোরা বহিরাগত। আমায় নিয়ে কথা বলবি না। খুব সাবধান।’
দাদু দিল্লি যাওয়ার সময় মান্তুমাসিকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে টিকতে পারেনি। দাদুর লোকজনের সঙ্গে ঝুট ঝামেলা করে চলে এসেছে।
দাদু শান্ত মানুষ। তাই রাগ না করে কলকাতার বাড়ির সব দায়িত্ব মান্তুমাসির হাতে দিয়েছে। আমার তিন মামা। তারা দাদুর কথা মেনে নিয়েছে।
সবাই ভেবেছে মান্তুমাসির নিজের সংসার তো হল না। কিছু একটা নিয়ে থাক। সেই থাকাটা যে সবার কাছে দিনের পর দিন এমন ভয়ানক হয়ে উঠবে, তা কেউ ভাবতে পারেনি।
সংসারে মান্তুমাসির কথাই শেষ কথা। অন্য কেউ কথা না বলে হাবার মতো তাকিয়ে থাকে। আর মাঝে মাঝে বোকার মতো হাসে।
বড়োমামা অঙ্কা। একসময় গায়ক হিসেবে নাম ছিল।এখন মান্তুমাসির লেখা গান গাইতে বাধ্য হয়।
একটা গান লোকের মুখে মুখে ঘোরে। ‘সায় দিয়ে আমার নামে, যা তোরা জাহান্নামে।’ বড়োমামা এর মানে জানতে চেয়েছিল। সেই রাগে মান্তুমাসি বাড়ি ছেড়ে কয়েকদিন পাড়ার একটা ক্লাবঘরে গিয়ে ছিল।
বাড়ির ইজ্জত বাড়িতে ফিরিয়ে আনবার জন্য সবাইকে কথা দিতে হয়েছে, কেউ কিছু জানতে চাইবে না। যা ইচ্ছে মান্তুমাসি তাই বলবে। সবাইকে ঘাড় দুলিয়ে তাতে সায় দিতে হবে।
মেজমামা বঙ্কাও কোন কথা বলেনি। ছবি এঁকে নাম হয়েছিল বঙ্কা মামার। সেই নাম এখন ধুলোয় মিশে গেছে। রঙ তুলি নিয়ে মান্তুমাসি যখন ছবি আঁকে,বঙ্কামামা তখন তল্পি বাহক হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে দেখে। আর নাকি সুরে বাহা বাহা করে দাড়ি নাচায়।
ছোটো মামা শঙ্কা সবসময় শঙ্কিত। কবিতা লিখত। এখন মান্তুমাসির লেখা ছড়া শুনে পিলে চমকে যাওয়া আটকে রাখতে রাখতে ঘাড় কাত করে থাকে।
কখন মান্তুমাসি চটে গলার শিরা ফুলিয়ে, হাত দুলিয়ে দুলিয়ে চিৎকার করে উঠবে তিন মামা এই নিয় সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে। আরও একটা ভয় আছে। প্রতিমাসে হাত খরচ বন্ধ হওয়ার।
মান্তুমাসি প্রায়ই চিৎকার করে বলে, ‘সংসারে আমার যে এত ত্যাগ তা কেউ দেখে না। আমি নিজের জন্য একটা পয়সা খরচ করি না। আমার বুঝি গয়না পরতে ইচ্ছা করে না? সাজতে ইচ্ছা করে না? বাড়ির সব কটা লোভী, ভোগী। আমার এখানে থাকবে, খাবে আর চক্রান্ত করবে।
সবাই ভাবে টাকা পয়সা তো বাবা পাঠায়। সেই টাকায় মান্তুমাসি নিজের নাম দিচ্ছে কেন? এই বাড়িটা তো সবার এখানে সবাই থাকতে পারে। মান্তুমাসি রেগে যা ইচ্ছে তাই বলে কেন? প্রশ্নটা মাথায় আসে, তবে মুখে বলতে পারে না। কিছু বললেই তো তেড়ে আসবে।
মান্তুমাসি বলে, ‘আমিই একমাত্র ত্যাগী। সংসারে সেটা কেউ না বুঝে এমন করে, মাঝে মাঝে মনে হ্য় আমার গোটা মাথাটাই বুঝি খারাপ হয়ে গেছে।’
কিছু বলতে গেলেই যদি সত্যি মাথা খারাপ হয়ে যায়, তবে সে হবে এক বিটকেল অবস্থা। সুস্থ মাথায় এই! মাথা খারাপ হলে যে কী হবে ভাবতেও ভয় করে।
বহুদিন সবাই চুপ থেকেছে। এবার আর একটা কথা না বলে পারেনি।
সেই কবে দশবছর আগে শীতকালে বাড়িতে পিঠে হয়েছিল। তাও হত না। দাদু এসে সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছিল। মান্তুমাসি বাধ্য হয়েছিল খাওয়াতে। তারপর থেকে প্রতিবছর শীতে হোয়াটস অ্যাপে গাদাগুচ্ছের পিঠেপুলির ছবির সঙ্গে নিজের হাসি হাসি মুখের ছবি পাঠায়। আর ছবির উপরে লিখে দেয়, ‘কেমন পিঠে খাইয়েছিলাম? পিঠে আমার ভালোবাসা। পিঠে আছে আমার অন্তরে। কথাটা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে।’
মামাদের মাঝে মাঝে এটা সেটা দিয়ে মুখ বন্ধ রাখে।
আমরা থাকি মুম্বাইতে। ছোটোমাসিরা বিহারে। কলকাতায় গেলে মান্তুমাসির কাছে আমরা সবাই বহিরাগত। মান্তুমাসির সঙ্গে গলা মেলায় মামারাও।
আমার মা আর মাসির সঙ্গে মামাদের তফাৎ শিরদাঁড়ায়। কাজেই দাদুকে ফোন করে মা আর মাসি বাধ্য হয়ে শীত যাই যাই অবস্থায় সবাইকে নিয়ে এসেছে।
আমাদের দেখে মান্তুমাসি মুখ কঠিন করে লম্বা বারান্দায় একবার এমাথা আরেকবার ওমাথা করছে।
মা মাসি বলেছে, পিঠেপুলি খাওয়াবার জন্য আলোচনায় বসতে হবে। তা না হলে দাদুর কলকাতার বাড়ি চালাবার দায়িত্ব অন্য কারও হাতে দিতে হবে। দাদু চায় সোনার সংসার গড়ে তুলতে। মা আর ছোটোমাসি বলেছে, দরকার হলে দাদুকে মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতে হবে। এর একটা বিহিত করতে হবে। বাড়ির পিঠের ঐতিহ্য নষ্ট করতে দেওয়া যাবে না। বাধ্য হয়ে আলোচনায় বসতে হয়েছে।
সবাই মান্তুমাসিকে ঘিরে বসেছি। সঙ্গে মুড়ি আর চপ।
মান্তুমাসি বলল, ‘এই অঙ্কা শোন। উত্তরদিকের জমির সীমানায় গোটা কুড়ি নারকোল গাছের চারা লাগিয়ে দিবি। আর খেজুর গাছের চারাও লাগাবি।’ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ক’টা হলে ভালো হয় বল তো?’
মা কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘ওই কুড়িটাই হোক।’
‘ঠিক আছে । আমি কিন্তু বসে নেই। এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভেবেছি। এটা তোরা মাথায় রাখবি।’
ছোটোমাসির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর তুই বল কটা গরু আনাব।’
ছোটোমাসিরও মায়ের মতো অবস্থা হল। কেমন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘কুড়িটাই আনাও।’
আমার বাবা চুপ করেই থাকে। ছোটো মেসো বলল, ‘এই গরুগুলি কি পাচারের?’
কটমট করে মেসোর দিকে তাকাল মান্তুমাসি। ‘কথা বুঝে বলবে। সবার সব কথার জবাব আমি দেব না।’
ছোটোমাসির ছেলে বুটাই বলল, ‘লেকিন ইয়ে সব কিসলিয়ে?’
‘এই তুই সেদিনকার একটা কুটুস, পুটুস, ফুটুস। ফোলা, গোলা। হাম কো হিন্দি দেখাতা হায়? জানতা হায় হাম হিন্দি জানতা হায়। গুজরাটি জানতা হায়। রাশিয়া জানতা হায়। বুলগেরিয়া জানতা হায়। অ্যামাজন জানতা হায়। হাম সবকো অ্যামাজনমে বিক্রি করকে, ফ্লিপকার্টো থেকে কিনতা জানতা হায়।’
মান্তুমাসি হায় হায় করতে করতে বুটাইকে ধমকেই চলল।
বুটাই অবাক হয়ে বলল, ‘ক্যা বোলা ম্যায়নে! ইসমে প্রবলেম কেয়া?’
মান্তুমাসি বলল, ‘পবলেম হায়। হাম তোমাকে কান পাকাড়কে হিন্দি শেখা দেব হায়। হামকো জানতা নেহি হায়।’
অঙ্কা, বঙ্কা, শঙ্কা মামা তিনজনে মিলে মান্তু মাসিকে শান্ত করবার চেষ্টা করল।
মা বলল, ‘একটা বাচ্চা ছেলে কি বলল তাতে তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন?’
‘আমি সবার ভালোর জন্য ভাবতা হায়। আর আমাকে বলতা হায়?’
বুটাইকে এত কথা বলায় ছোটোমাসি রেগে গেল। বলল, ‘সব সময় তুমি চিৎকার করলেই ভেবেছ তা মেনে নেব? আমিও জিজ্ঞাসা করছি নারকোল গাছ, খেজুর গাছ, গরু এসব লাগবে কি জন্য?’
‘তোরা পিঠে খাবি বলে শীত শেষ করে এত দূর থেকে এলি, তো আমি তোদের পিঠে খাওয়াবার জন্য ভাবব না? পিঠে খেতে নারকোল,খেজুরগুড়,দুধ লাগবে সেই ব্যবস্থাই তো করছি।’
বুটাই বলল, ‘হায় রাম! তব ইয়ে কিতনা দিন কা বাদ হোগা? তব তক তো বারিষ আ জায়গা!’
মান্তুমাসি রেগে চিৎকার করে উঠল, ‘এই তুম হামকো রাম শুনায় গা? রাম বলা হায়? আমারই ঘাড়ে বসে পিঠে খায়গা, আর আমাকেই রাম শুনায়গা? আমিও জানতা হায়। বিশ্বকর্মা মাই কি জয়। তুম জানতা হায়? আমি সবজান্তা হায়।’
একটু থেমে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি দরকার হলে সবাইকে নিজেই ডেকে নেব। গাছ প্রকল্পগুলি বড়ো হলেই তারপর পিঠে উৎসব হবে । শুধু শুধু বাবার কাছে নালিশ করে আমার এই মহৎ কাজটাকে আটকে দিস না। দরকার হলে পিঠে খাওয়ার পরে আমি তোদের বাসন মেজে দেব। আমাকে দরকার হলে একটা থাপ্পড় মার। তবু বাবাকে নালিশ করে এই সংসার চালানোটা বন্ধ করিস না।’
বুটাই মান্তুমাসির কথা শুনে গোল গোল চোখ করে আবার বোধহয় রামকে ডাকতে যাচ্ছিল। আমি হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলাম।
ও আমার হাত ছাড়িয়ে বলল, ‘দাদারে ইয়ে সব কেয়া বোলতা? সমঝমে নেহি আতা। মালুম হোতা হায় কি হমলোগ তো তব তক বুডঢা হো যায়গা।’
বললাম, ‘বুঝতে পারছিস না? সবাইকে এইসব শুনে দিনেরবেলায় আকাশের তারা গুনতে হবে। এই হচ্ছে গিয়ে গরম গরম মান্তুমাসির পিঠেপুলি।’

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।