সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ১৭)
কেল্লা নিজামতের পথে
আজ ভাগ্যের চাকায় ভেসে যাচ্ছে ভাগীরথীর জল
একে একে প্রাণ দিতে হচ্ছে সব বিশ্বাসঘাতকদের। ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদ থেকে মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে ঘসেটি বেগম ওরফে মেহেরুন্নিসা বেগম তলিয়ে গেছেন ভাগীরথীর গর্ভে। সারা শরীরে কুষ্ঠ নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন একদা ক্লাইভের পুতুল নবাব মীরজাফর। হিস্যার টাকার নেশায় মসনদের নিলামদার উমিচাঁদ পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাস্তায় রাস্তায়। বর্ষার বজ্রপাতে দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে মৃত্যু হয়েছে মীরজাফর পুত্র মীরণের। একটি হাত পবিত্র কোরানে ও আরেকটি এই মীরণের মাথায় রেখেই ইংরেজ গোলামীর শপথ করেছিল পিতা মীরজাফর। রক্ষা হয়নি সেই মাথার। বিদ্যুৎপৃষ্ট মীরণের দেহ পাওয়া গেছিলো কিনা তা জানা নেই ঠিকই, কিন্তু বিস্বাসঘাতকতার অভিশাপ ফেলে আজও শক্ত মেরুদণ্ডে দাঁড়াতে পারেন নি মীরজাফর পরিবারের সদস্যরা।
এ কোন নিষ্ঠুর অভিশাপ? কোথায় সাধের হীরাঝিল প্রাসাদ৷ কোথায় মোহনলাল, মীর মদন? হিরাঝিলের তামাম ঐশ্বর্য ছেড়ে আজ জহুরা খেলছে অন্ধকার ভগবান গোলায়। ওখানেই মিলিয়ে গেছে আগামীর ভোর। কাল হয়তো আর সূর্য উঠবেনা বাংলার আকাশে, হয়তো আর রোদ এসে পুড়িয়ে দেবেনা হিরাঝিলের খোলা বারান্দাটুকু।
“…. কে কে?? প্রিয় মোহাম্মদী বেগ? একি.. তোমার হাতে খোলা তরবারি কেন? সঙ্গে কারা? তুমিও ওদের দলে? হত্যা করবে আমায়? তোমায় তো অনেক স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন আমারই আম্মিজান.. সে কি আজ তোমার কেউ নয়? আজ আমি তোমায় বলবো না আমায় বেগুনাহ খালাস করে দিতে.. গুনাহ আমি করেছি.. অনেক করেছি.. হে বিসমিল্লাহ রহমান রহিম.. রেহা করো তোমার এই দাসকে.. ভালো রেখো বাংলার মাটিকে.. বাঁচিয়ে রেখো ছোট্ট জোহুরাকে আর আমার হিরাঝিলকে.. এছাড়া আজ কিই বা চাওয়ার আছে আমার..”
এভাবেই হয়ত আর্তনাদ করে উঠেছিল ২৩ বছরের নবাব সিরাজ। ২রা জুলাই, ১৭৫৭। হয়তো মৃত নবাব জেনেও যান নি ঠিক কে কে জড়িত ছিল এই মহা প্রহসনে। পলাশীর যুদ্ধ করতে যাবার আগে ঠিক কতজন বুনেছিলেন নেমকহারামীর দলিল। সেনাপতি মীরজাফর, মীরণ, ইয়ার লতিফ খান, ঘসেটি বেগম, সিরাজেরই মা আমিনা বেগমের পালিত পুত্র মোহাম্মদী বেগ, সেনাপতি রায় দুর্লভ, ঢাকার রাজা রাজ্ বল্লভ, মীর জাফরের জামাই মীর কাসিম, উমিচাঁদ, ধনকুবের জগৎ শেঠ, মহারাজা নন্দকুমার, কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এবং আরো কত কত নাম। বাংলা বিক্রির জন্য কিভাবে যেন মাইল গিয়েছিলো সব চক্রান্তের নায়কেরা। কিন্তু কেন? কেন একজন তরুণ নবাবের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে রাজি হয়ে গেলেন মুর্শিদাবাদ থেকে সারা বাংলার বিভিন্ন জমিদারবর্গ ও রাজকুল।
এদিকে ঘটছে আর একটা ঘটনা। সালটা ১৮১১-১২ হবে। ময়মনসিংয়ের গোঁড়া হিন্দু বংশের জমিদার যুগল কিশোর রায়চৌধুরীকে হিন্দুমতে দাহ করার পরিবর্তে গোপনীয়তার সাথে সমাধি দিলেন তাঁর পুত্র প্রাণকৃষ্ণনাথ রায়চৌধুরী। এ কোন আশ্চর্য গল্পকথা? গল্প তো নয়ই, বরং ঐতিহাসিক সত্য।যুগলকিশোর ছিলেন ময়মনসিংহের জমিদার কৃষ্ণগোপাল রায়চৌধুরীর দত্তক পুত্র। কিন্তু কৃষ্ণগোপাল কিভাবে ও কার থেকে দত্তক নেন পুত্র যুগলকে? পিছিয়ে যেতেই হবে আরো কিছু বছর। নেপথ্যে মুর্শিদাবাদের নবাবী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। সদ্য কাশ্মীর থেকে বাংলায় এসেছেন মোহনলাল। যোগ দিয়েছেন নবাব আলীবর্দীর সেনাপ্রধান হিসাবে। কিন্তু কখন যে তাঁর বোন মাধবীর সাথে অন্দরমহলে প্রেম হয়ে যায় বালক নবাবজাদা সিরাজের সাথে, তা কেউ জানতেই পারে না। ঘটনাচক্রে মাধবী ওরফে হীরার গর্ভে জন্ম নেয় সিরাজের এক শিশুপুত্র। অতি গোপন ভাবে সিরাজ তাঁকে ঘোড়ার পিঠে বেঁধে চুটিয়ে দেন রাজধানীর বাইরে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই জানতে পারেন সেনাপতি মোহনলাল। এবং উদ্ধার করে আনেন সেই শিশুকে। পরে নবাব আলীবর্দী খান সব জানতে পারলে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে মাধবীর সাথে সিরাজের বিবাহ দেন এবং তাঁর নতুন নাম দেন আলেয়া বেগম। আজও খোশবাগে সিরাজ, আলীবর্দী ও লুৎফুন্নিসার সমাধির পাশে তাঁর সমাধিও দেখা যায়। তার থেকেই সহজে বোঝা যায় প্রাসাদের অন্দরমহলে ঠিক কতটা শ্রদ্ধার জায়গা পেয়েছিলেন মোহনলালের বোন আলেয়া বেগম। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধে পালাপরিবর্তনের পর মোহনলাল ছয় বছরের শিশুটিকে নিয়ে পালিয়ে যান ময়মনসিংহে এবং পরিচয় গোপন রেখে জমিদার কৃষ্ণকিশোর রায়চৌধুরীর ভাই কৃষ্ণগোপাল রায়চৌধুরীকে শিশুটি দেন করেন লালনপালন জন্য। তখন ধুমধাম করে তাঁর নামকরন করা হয় যুগলকিশোর। কৃষ্ণগোপাল ছিলেন নিঃসন্তান, তাই শিশুপুত্র পেয়ে তিনি তাঁকে নিজ পুত্র পরিচয়ে অন্তঃপুরে তাঁকে মানুষ করে তোলেন। আর মেলাতে বাকি থাকে কি কালচক্রের আবর্তন? মুসলিম নবাব পুত্রের ব্রাহ্মণ পরিবারে বেড়ে ওঠা, তামাম বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অধীশ্বর হবার কথা যাঁর, সেখানে সামান্য জমিদার হিসাবে আত্মপরিচিতি এবং অতঃপর পারিবারিক চক্রান্তের হাত থেকে বাঁচতে ও ইংরেজ কোম্পানি বাহাদুরের কাছে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে আবার শেষ জীবনে আত্মগোপন করা, এই ছিল ইতিহাসের অব্যক্ত অধ্যায়টুকু। যদিও সিরাজের একমাত্র কন্যা উম্মে জহুরার নবম বংশধর আজও ঢাকা শহরের বাস করেন ছোট্ট দুকামরার ঘরে এবং দুই দেশের সরকারের কাছেই দাবি জানিয়ে আসেন নিজেদের অস্তিত্ব। নবাবী চলে গেছে, চলে গেছে ইংরেজও, কিন্তু এখনো রাখা আছে হিরাঝিলের ভাঙা ইটের টুকরো, পলাশীর অভিশপ্ত মাঠ আর চক্রান্তের অন্যতম নিদর্শন জগৎ শেঠের বাড়ি ও মতিঝিলের কিছু অংশ। আর গঙ্গার অন্যপাড়ে চিরনিদ্রায় শুয়ে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সাক্ষ দিচ্ছেন তাঁর শেষের দিনগুলো এবং সন্দিগ্ধ চোখে আমাদের দিকেই তাকিয়ে কখনো চিৎকার করে বলছেন – “তোমরাও বিশ্বাসঘাতক। তোমরাও কুক্ষিগত করে নিয়েছো তামাম বাংলার খোয়াবকে.. তোমরা হত্যাকারী। তোমরা হত্যাকারী… তোমরা হত্যাকারী…”