সাপ্তাহিক শিল্পকলায় “ভারত ও পাকিস্থানের দুই পিকাশো – ৪”- লিখেছেন আলবার্ট অশোক (পর্ব – ১৯)

আগের ৩ টি পর্বে মকবুল ফিদা হোসেন, সৈয়দ সাদেকোয়ান আহমেদ নকভি  এই দুজনের পরিচিতি ও কাজের নমূনা সম্পর্কে বলেছি। এখানে মকবুল হোসেনের কিছু ছবি ও তার ব্যক্তিগত জীবনের উপর আলোকপাত করছি।

মকবুল ফিদা হোসেন, সৈয়দ সাদেকোয়ান আহমেদ নকভি – ৪

HUSAIN: One of 12 paintings in the series “M.O.T.H.E.R”.

শুধু ছবি আঁকলেই বড় বা নামী হওয়া যায়না।বহু শিল্পী জন্মান, মাথা গুঁজে কাজ করে যান, তারা শুধু তাদের পারিশ্রমিকটিকুই পান বা অর্জন করেন। তারা দেশের বা দশের মধ্যে বিরাজ করতে পারেননা। দেশের ও দশের মধ্যে বিরাজ করতে হলে দেশ ও দশকে নাড়াতে হবে। কিভাবে নাড়াবেন তা শিল্পী স্থির করে নেন। পাবলিকের সেন্টিমেন্ট বা বিনয়কে ঝাঁকুনি দিতে হয়। যেমন ধরুন, বিখ্যাত তসলিমা নাসরীন কে অনেকেই সাহিত্যিক বলে মানেননা, সম্ভবত আমরা তার নামও শুনতামনা যদি না তিনি তার লেখা ‘নির্বাচিত কলাম’ এ মুসলিম সমাজকে ক্ষেপিয়ে দেশ থেকে পালাতেন।
বা তার যৌনজীবন নিয়ে  লেবুঞ্চুস বানিয়ে মানুষকে খাওয়ানো – এসব তার পরিচিতির বড় অংশ জুড়ে আছে। যারা সাংবাদিক বা রিপোর্টার তারা এত কিছু বুঝেনা, তাদের রিপোর্ট বিক্রীসম্মত কিনা, এতটুকুই তারা দেখে। দেখা গেল একদম ফালতু জিনিস প্রচার মাধ্যমে বিশাল হয়ে গেছে।
 তো যারা অর্থ যশ চান তারা জানেন, প্রচার মাধ্যমকে বগলদাবা করে না রাখতে পারলে অর্থ যশ আসবেনা।

Mahabharat, oil on canvas, 129.5 × 477.5 cm, 1990. Courtesy: Chester and Davida Herwitz Collection

মকবুল ফিদা হোসেন এই প্রচার মাধ্যমকে খুব সুন্দর ব্যবহার করে, মানুষকে নাড়িয়ে গেছেন। মানুষ তাকে নিয়ে চর্চা করেছে। তবে তার প্রতিভা কোন অংশে কম ছিলনা। সাধারনতঃ মানুষের জীবনে, খ্যাতি বা যশ আসে, ৬০ বছরের কাছাকাছি গেলে । দু একটা সোনার মেডেল বা জাতীয় পুরস্কার অনেক মানুষকেই এনে দেয়, কিন্তু তারা বিখ্যাত হননা সকলে। বিখ্যাত হন তারাই যারা ক্রমাগত কাজ তাদের জীবনের ৬০ বছরকে পার করিয়ে নিয়ে গেছেন। ৫০/৬০ বছর পেরোনো মানুষ অভিজ্ঞতা ও ্কাজের কৌশলে দক্ষ থাকেন। ও ইতিপূর্বে তারা তাদের ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে রেখেছেন। কিন্তু অনেকেই ৬০ বছরের কাছে এসে বাঁচেননা। তারা এখানেই মিলিয়ে যান দৃশ্যের আড়ালে।
মকবুলের জীবন দীর্ঘায়িত ছিল। ১৯৭৫ এর  আগে তিনি খুব পরিচিত লাভ করেননি। ১৯৭৫ সালে তাঁর বয়েস ৬০ বছর। আমার মনে হয়, বিজ্ঞান বা যুক্তি দিয়ে যা বোঝা যায়না তা হল ভাগ্য। হুসেনের ভাগ বা নিয়তি এমন লেখে ছিল যে তিনি সম্রাট হবেনই। চলুন তার জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ও সময়টা দেখি।

M.F. Husain. Lightning, 1975. Oil on canvas. Twelve panels, overall: H.10 x W. 60 ft. (3 x 18 m). Marguerite and Kent Charugundla Collection. Image courtesy of the lenders.

এম.এফ. হুসেন, ১৯৭৫ সালে বোম্বাই (মুম্বাই) -তে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস পার্টির জনসভায় মুরাল-আকারের পেইন্টিং  তৈরি করেছিলেন, একই বছর ভারতে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছিল এই কাজের বারোটি বিশাল প্যানেলে বন্য, সাদা ঘোড়ার আক্রমণ ভারত এবং১৯৭০ সালের -সত্তরের দশকে যে নতুন জাতির রাজনৈতিক আবহাওয়া ছিল তিনি তার ছবির মাধ্যমে তুলে ধরেন।

MF Husain, Zameen, 1955/1956, oil on canvas, 91.5 x 548.5 cm (without frame) | Courtesy: Collection of the National Gallery of Modern Art, Delhi

১৯৫৫ সালে, হোসেনের শক্তিশালী একটি ছবি,টাইটেল, ” জমিন”Zameen ললিতকলা একাডেমিতে জাতীয় পুরস্কার জিতেছিল এবং পরের বছর প্রাগে ( Prague) আরও একটি একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৬ সালে, সে বছর হুসেনকে চেকোস্লোভাকিয়ায় ৩৪ টি শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর জন্য আমন্ত্রণ পান। হোসেনের ভাগ্য এই তিনি শিল্প জীবনের শুরু থেকেই  সার্থকতা পান, তার বড় বড় কেস্টবিস্টু লোকের সাথে, শিল্প অনুরাগী ধনী ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তার ব্যবহার , চেহারা ও পরিশ্রম  তাকে গণেশ ও লক্ষীর বর দানে পূর্ণ করে রেখেছে। যেটা অনেক শিল্পীর থাকেনা। বাস্তবিক অনেক শিল্পী কথা বলতেই শেখেনি। গ্যালারিতে দর্শক দেখলে পালিয়ে থাকে, পাছে দর্শক কোন প্রশ্ন যদি জিজ্ঞেস করে ফেলে!
হোসেনের খালি পায়ে হাঁটার একটা গল্প আছে। তবে সারা জীবন তাকে খালি পায়ে দেখা যায়নি। সাহেবদের মত জামা জুতা টাই পরিপাটি থেকেছেন।
১৯৬৪ সালে “উত্তাপ অনুভব করতে” হিন্দি কবি গজানন মাধব মুক্তিবোধের  শেষকৃত্যের সময় দিল্লীর নিগম্বোধ ঘাটে (Nigambodh Ghat in Delhi ) খালি পায়ে হেঁটেছিলেন  শেষ বিদায় জানাতে। তারপর থেকে তিনি অনেকদিন খালি পায়ে থাকতেন। তবে এটি হঠাৎ মানসিক সিদ্ধান্ত নয়। যেহেতু তিনি মুসলিম সমাজে বড় হয়েছিলেন, কারবালার ঘটনা (ইরাকে) তার চিন্তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে।
হুসেন একবার উল্লেখ করেছিলেন যে তার বাবা তাকে বলতেন যে তাঁর পা তার মায়ের মতো । অতএব, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি জুতা পরবেন না!
খালি পায়ে সাধুদের  ঐতিহ্য ভারতে রয়েছে। তবে এখানে তিনি এক উদীয়মান ও অভিনব চিত্রশিল্পী যিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন মাতৃভূমিকে এবং যেখানে তিনি সর্বদা ফিরে আসতে চেয়েছিলেন।
হোসেন সবসময় চেয়েছিলেন খবরের মাধ্যমে থাকতে এবং তিনি সেটা করতে পেরেছিলেন।

Untitled, photographs of a performance, 1975.

Last Supper in Red Desert, acrylic on canvas with umbrella and suitcase, 2008.

১৯৭০সালে হুসেন কিছু হিন্দু দেবী – দুর্গা ও সরস্বতীর ছবি নগ্ন করে এঁকেছিলেন, সেগুলি নিয়ে ‘বিচার মীমাংসা’  ‘Vichar Mimansa’ বলে একটি সাময়িক পত্রে ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশ হয়।(In September 1996, an article by one Om Nagpal, titled Is he [Husain] an artist or a butcher?) লেখক ওম নাগপাল, রচনার শীর্ষক হল ‘ তিনি শিল্পী না কসাই?’। হোসেন: একজন চিত্রশিল্পী বা কসাই ‘। নিবন্ধটি প্রকাশের পরে হুসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোষ্ঠীর তরফে হুসেনের  বিরুদ্ধে ৮ টি  মামলা/ অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। অভিযোগ এই মকবুল হোসেন হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা সৃষ্টির কারণ করছেন।
 ১৯৭০ সালে হোসেনের উপর একটি বই প্রকাশ হয়, বইটির নাম Husain – Riding the Lightning by Dnyaneshwar Nadkarni। বিচার মীমাংসার সম্পাদক , V.S. Vajpayee হোসেনের ছবিগুলি এই উল্লেখিত বইটা থেকে নিয়ে ছেপেছিলেন।

মহারাস্ট্রের শিবসেনার কালচার মন্ত্রী প্রমোদ নভাল্কর পুলিশ কমিশনারকে অভিযোগ গুলি জানান ও কড়া হাতে দমন করতে বলেন। পুলিশ তা করল। The Mumbai Police treated the letter as a complaint and registered a case on October 8, 1996, against Husain under Sections 153A (promoting enmity between different groups on account of religion, etc.) and 295A (deliberate and malicious acts intended to outrage religious feelings of any class) of the Indian Penal Code (IPC).
সাথে সাথে হিন্দু উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠিগুলি মাঠে নেমে হুসেনের বাড়ি, গ্যালারী সব ছবি ধ্বংস করে। ও হুসেনকে মৃত্যুর হূমকী দেয়।  হোসেন লন্ডনের এক সংবাদ পত্রকে জানান, প্রায় ৩০০০ মামলা হিন্দু বাদীরা  হোসেনের বিরুদ্ধে করেছে। এরপর জনসাধারণের  কাছে ভারত কি করে গণতান্ত্রিক দেশ স্রীকৃতি পায়। একজন শান্ত শিল্পী, যে ভারতের গর্ব , তার পিছু কিছু দুস্কৃতি  হিংসা ছড়াচ্ছে, আর ভারতের প্রশাসন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে!

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।