সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ২১)

কলকাতার ছড়া

ভারতে আসবেন বলে মায়ের কাছে আর্জি রাখলেন যুবরাজ। প্রথম থেকেই বড়ছেলের সাথে মায়ের সম্পর্কের তীব্র টানাপোড়েন। সেই নিয়ে প্রায় তোলপাড় বিলেত। কিন্তু কে এই বিশ্ববিখ্যাত মা আর ছেলে। আর কেউ নন। স্বয়ং মহারাণী ভিক্টোরিয়া আর তাঁর বড়ছেলে (বড় মেয়ে ভিকির পরে) প্রিন্স অফ ওয়েলস এডওয়ার্ড অ্যালবার্ট ওরফে যুবরাজ বার্টি। কিন্তু হঠাৎ যুবরাজের হঠাৎ ভারতে আসবার বায়না কেন? আলোচনা এগোতে গেলে সুদূর বিলেতের মাটিতে পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কিছু যুগ। ব্রিটেন ও ভারত তখন মহারাণী ভিক্টোরিয়ার হাতে। পরাধীন ভারতবর্ষের তিনিই সম্রাজ্ঞী। কিন্তু তা বললে কি হবে। ঘরের অভ্যন্তরে বিবাদের অন্ত নেই৷ বড়ছেলে বার্টিকে নিয়ে অশান্তির শেষ নেই। তখন দাদু, জ্যেঠাদের লাগামছাড়া বিশৃঙ্খলা থেকে আপামর মানুষের চোখে রাজপরিবারের সম্ভ্রম ফেরাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন রানী ভিক্টোরিয়া ও তাঁর স্বামী অ্যালবার্ট। কিন্তু কাঁটা একমাত্র বার্টি। রেসের মাঠ থেকে জুয়ার ময়দান, মহিলা মহলে ওঠাবসা থেকে যত্রতত্র পশু শিকার, সবেতেই বার্টির অবাধ যাতায়াত। হাজার চেষ্টা বৃথা, বার্টিকে বাগে আনা সারা ব্রিটেন-ভারত দাপিয়ে শাসন করা ভারতেশ্বরীর কাছেও মুখের কথা নয়। কিন্তু শেষমেশ একরকম ধরে বেঁধে ড্যানিশ রাজকুমারী আলেজান্দ্রার সাথে বিয়ে দেওয়া হয় রাজকুমারকে। কিন্তু বিয়ের আগেও অভিনেত্রী ক্লিফডেনের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে তোলপাড় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম। ছেলেকে বোঝানোর জন্য অ্যালবার্টও ছুটে যান কেমব্রিজে ছেলের কাছে৷ অ্যালবার্ট শৃঙ্খলাপরায়ণ, নীতিবাগীশ। কিন্তু ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে কই। কিন্তু ভিক্টোরিয়া-বার্টি সম্পর্ক ব্রিটেনের চিরকালীন চর্চার বিষয়। এমনকি বাবা অ্যালবার্টের মৃত্যুর পরে ছেলেকে দোষারোপ করতেও ছাড়েন নি ভারত সম্রাজ্ঞী। বারবার মেয়ে ভিকিকে তিনি লিখছেন, অ্যালবার্টকে বার্টি এতবার মনোকষ্ট দিয়েছেন, তাতেই শেষরক্ষা করা সম্ভব হল না। যদিও বাবার মৃত্যুর খবর বোনের কাছ থেকে পেয়ে বাকিংহামে ছুটে গেছেন বার্টি। কিন্তু মায়ের সাথে ছেলের অভিমানের শেষ নেই। এমনকি মা-ছেলের সম্পর্কের টানাপোড়েন সামলাতে প্রায় শশব্যস্ত হয়ে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী ডিসরায়েলিও।
এহেন যুবরাজের হঠাৎ ভারত যাবার বায়নায় শিলমোহর দেওয়া মা ভিক্টোরিয়ার জন্য যে কতটা কঠিন, তা সহজেই বোঝা যায়। তাও যেখানে সরকারী প্রায় কোনো কাগজপত্র বড়ছেলে হওয়া সত্ত্বেও বার্টিকে ছুঁতে পর্যন্ত দেন না রাণী। কিন্তু যুবরাজের আর্জি ঠেলাও সম্ভব হল না শেষমেশ। মিলে গেল ছাড়পত্র। অবশেষে জাহাজে চড়ে শাসনভূমি ভারতে আসছেন যুবরাজ। এদিকে তো সাজো সাজো রব। এদেশের মানুষ তখন ভিক্টোরিয়া-বার্টি সম্পর্কের কতটুকুই আর জানে। ব্রিটেনের খবর খুব একটা যে এদেশের সংবাদপত্রে ছাপা হয় তাও নয়। অভিযাতদের মুখে মুখে কেবল যেটুকু ছড়িয়ে যায় কলকাতার রাস্তায়। ১৮৭৫ সালে কলকাতার সমস্ত সংবাদপত্রে ছাপা হল যুবরাজ বার্টির ভারতে আসবার খবর। শহরের রাস্তায় সে এক মস্ত আয়োজন। দিকে দিকে সাজো সাজো রব। তখন তো আর মাঠে মঞ্চ নির্মাণের প্রচলন ছিল না, তাই যুবরাজকে অভ্যর্থনার জন্য পাকাপাকিভাবে তৈরি হল স্তম্ভ, মিনার। ১৮৭৫ সালে ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখ কলকাতা শহরে পা রাখলেন ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অফ ওয়েলস এডওয়ার্ড অ্যালবার্ট সাহেব। সুপুরুষ চেহারা, যত্ন করে দুপাশে সাজিয়ে আঁচড়ানো চুল। জাহাজ থেকে নামতেই তাঁর চেহারাটুকু একবার দেখতে ভিড় শহরের চারদিকে। আজকের দিন হলে হয়ত টিভি মিডিয়ায় সারাদিন লাইভ টেলিকাস্ট হত যুবরাজের গতিপথ। কিন্তু সেযুগ আর এযুগ এক নয়। একবার যুবরাজকে চোখের দেখা দেখতে বাঙালির তখন রাস্তার দুপাশেই হুড়োহুড়ি। স্ট্র‍্যান্ড রোড ও চৌরঙ্গীতে যুবরাজকে সংবর্ধনা জানাতে মিনার বানালেন ঢাকার নবাব আব্দুল গণি (আজও মিনার দুটি বিদ্যমান, যদিও ১৯৯২ সালে একটি ট্রাম দুর্ঘটনায় ধর্মতলার মিনারটির চুড়া ভেঙে যায়)। বার্টিও বেশ মজা পেলেন নতুন দেশে। ৮ মাসের এক দীর্ঘ সময়ের সফর। সুতরাং ভারতবর্ষটাকে ভালো করে চিনতেই তাঁর এদেশে আসা। দেখবেন এদেশের সংস্কৃতি, আদবকায়দা, মানুষের জীবন। মিশবেন বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজারাজড়াদের সাথে। জীবনে একটু ভিন্নতার স্বাদ না থাকলে যে বার্টির দিন ম্যাড়মেড়ে। কিন্তু চিন্তার শেষ নেই। ভারতেশ্বরীর। ছেলে বার্টি এই না কোনো গোল বাঁধিয়ে বসেন ভারতের রক্ষণশীল রাজপরিবারগুলোর অভ্যন্তরে। তাই সুদূর ব্রিটেনে বসেও যুবরাজের দিনলিপি ও কার্যকলাপে রাণীর তীক্ষ্ণ নজর। বার্টিও চিঠি লিখে মাকে জানান তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। সেইসময় ভারতেশ্বরী নিজেও বলেছেন বার্টির এইসমস্ত ‘বোরিং’ চিঠির কথা। তাই রাণীর হাজার আশঙ্কা থাকলেও বার্টি কিন্তু সেভাবে মায়ের মুখ ডোবাননি। বলাই বাহুল্য, বরং ভারতবাসীর মন জয় করলেন তিনি। প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন অভিজাত মহলে তাঁর ডিনারের ডাক। একটু একটু করে মিশে গেলেন কলকাতার হৃদয়ে। কিন্তু পিছনে সমালোচনারও শেষ নেই। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ রে রে করে উঠতেও ছাড়ছে না। এ কী করছেন যুবরাজ। এমনকি লেডি ক্লার্কের ডিনার পার্টি সেরে রাতে খোশমেজাজে রাত দুটো অবধি গল্প করলেন অভিনেত্রী লিজির সাথে। এহেন হোয়াইট টাউনের গল্প আপামর কলকাতার মানুষ সরাসরি চোখে না দেখলেও কানে শুনতে দেরি করত না। যুবরাজের ভারত সফর নিয়ে চুপ রইল না সংবাদপত্রগুলোও৷ কোথাও কোথাও রাজশক্তিকে তোষামোদের বিষয় থাকলেও অমৃতবাজার পত্রিকা সরাসরি তাঁর সফরের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। যুবরাজ বার্টির সফর ও তারজন্য বিপুল অর্থ ব্যয় ভারতবাসীর কী উপকারে আসবে তা নিয়ে হেডিং করলো অমৃতবাজার। আবার বিভিন্ন কাগজ আজকের দিনের মতো প্রতিদিন ছাপতে থাকলো তাঁর কর্মসূচি। এমনকি তাঁর ছবি দিয়েও প্রতিবেদন, কবিতা, ছড়া ছাপা হল বামাবোধিনী, বঙ্গমহিলার মতো প্রথম সারির পত্রিকায়।
যাই হোক, এভাবেই কাটছিল যুবরাজের কলকাতার দিনগুলো। কিন্তু হঠাৎ তাঁর এক আজব ইচ্ছে সবকিছু যেন ওলটপালট করে দিল নিমেষে। এ কোনো যেমনতেমন ইচ্ছে হয়। একেবারে গোঁড়া রক্ষণশীল বাঙালি হিন্দু ঘরের অন্দরমহলে ঢোকবার ইচ্ছে। সেযুগে এ খুব সহজ বিষয় নয়। কলকাতার গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদ যে কিভাবে গর্জে উঠতে পারে তা আগেও বারবার দেখেছে এদেশ। দেখেছে বিধবাকে বিয়ে দেবার ইচ্ছে নিয়ে ছুটে বেড়ানো মহামতি বিদ্যাসাগরকে কিভাবে বারবার হেনস্তা হতে হয়েছে স্বজাতির কাছেই। আর সেখানে বাঙালির শোবার ঘরে কিনা স্মেচ্ছ ব্রিটিশ যুবরাজ। একবার কল্পনা করে দেখুন তো। তবে আপনার কল্পনা শেষ করে ওঠবার আগেই কিন্তু যুবরাজের ইচ্ছে মেটাতে হাজির হয়েও গেল শহরের এক উদারমনা ব্রাহ্মণ। হাইকোর্টের সিনিয়ার প্লিডার ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের মান্যগণ্য সদস্য ভবানীপুরের জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়। ১৮৭৬ সালের ৩রা জানুয়ারি যুবরাজকে অভ্যর্থনা করে নিজের বাড়ির অন্দরমহলে নিয়ে গেলেন তিনি। বাড়ির দরজায় পরিবারের মহিলা সদস্যারা দাঁড়িয়ে শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে ও ফুল দিয়ে আদ্যোপান্ত বাঙালি প্রথায় স্বাগত জানালেন বার্টিকে। কিন্তু স্বভাবতই চুপ রইল না কলকাতা। গর্জে উঠলো সংবাদপত্র, পত্রিকা, গোঁড়া হিন্দুসমাজ।
রক্ষণশীল বাঙালির অন্দরমহল যুবরাজকে যে বেশ খানিকটা বিস্মিত করেছিল তা বলার অপেক্ষা থাকে না। তবে বার্টি তথা পরবর্তী ব্রিটিশরাজ সপ্তম এডওয়ার্ডের জীবনী গবেষকরা তাঁর কলকাতার জীবন নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখান নি। হয়ত রাজা হবার আগে প্রিন্স বার্টি তাঁর চরিত্রকারদের কাছে নিছক এক ছেলেমানুষের জায়গাতেই স্থান করেছিলেন বলে মনে হয়। কারণ ইংরেজ লেখকদের কাছে খামখেয়ালী বার্টির রাজা হবার আগের জীবন শুধুই যেন কিছু লণ্ডভণ্ড কাগজের পাতা। তবে কলকাতার সম্ভ্রান্ত মহল খুব ছোট ভাবে এই ঘটনাকে দেখেন নি কখনোই। অন্তত কলকাতার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুবরাজের সফর এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত ব্যঙ্গাত্মক ছড়া ও কবিতা গুলো সেযুগের কলকাতার নিরিখে বেশ আকর্ষনীয়ও বটে। যেমন –

“সাবাস ভবানীপুর সাবাস তোমায়
দেখালে অদ্ভুত কীর্তি বকুল-তলায়
পুণ্য দিনে বিশে পৌষ বাঙ্গলার মাঝে
পর্দ্দা খুলে কুলবালা সম্ভাষে ইংরাজে
কোথায় কৈশবদল, বিদ্যাসাগর কোথা
মুখুয্যের কারচুপিতে মুখ হৈল ভোঁতা
হরেন্দ্র নরেন্দ্র গোষ্ঠী ঠাকুর পিরালি
ঠকায়ে বাঁকুড়াবাসী কৈল ঠাকুরালি
ধন্য মুখুয্যের বেটা বলিহারি যাই
সস্তা দরে মস্ত মজা কিনে নিলে ভাই
ও যতীন্দ্র, কৃষ্ণদাস একবার দেখ চেয়ে
বকুল তলায় পথের ধারে কত শত মেয়ে
কাল ফিকে গৌর সোণা হাতে গুয়াপান
রূপের ডালি খুলে বসি পেতেছে দোকান
ধন্য হে মুখুজ্জে ভায়া বলিহারি যাই
বড় সাপ্টাদরে সাৎ করিলে খেতাব সি. এস. আই।”

গোরা ইংরেজদের ওপর তখনও এদেশের লোকজনের ক্ষোভ চরমে পৌঁছয় নি। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার তখন এখানেও বেশ কদর। ভারতেশ্বরীর নাম শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের সাথেই উচ্চারিত হয় কলকাতার মাটিতে। সুতরাং তাঁর পুত্রের অভ্যর্থনা যে এ শহর জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই করবে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু যুবরাজকে নিজের অন্দরমহলে তুলে নিজের বিপদ ভালোই বাড়ালেন জগদানন্দ। এমনকি ১৮৭৬ এর ১৯শে ফ্রেব্রুয়ারী গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত হল উপেন্দ্রনাথ দাসের কৌতুক ও শ্লেষাত্মক নাটক ‘গজানন্দ ও যুবরাজ’। জগদানন্দই ব্যঙ্গবিদ্রূপে হয়ে উঠলেন গজানন্দ।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সাউথ গেটের ওপরে ঘোড়ায় চড়ে সাহেবের মূর্তিটা মনে পড়ছে? তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং কলকাতা ঘুরে যাওয়া রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড ওরফে যুবরাজ বার্টি। তাঁর এ শহরের সফর আজ হয়ত আর মানুষের মনে নেই। কিন্তু এডওয়ার্ড রয়ে গেছেন কলকাতার মাটিতেই। মায়ের সাথে বিবাদ থাকলেও রাণী ভিক্টোরিয়ার সাথেই তার আজও সহাবস্থান।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।