সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ৯)

কলকাতার ছড়া 

প্রাচীন কলকাতায় পত্তন হয়েছিল বহু গঞ্জ হাট। সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক এইসব হাটে লেগে থাকত দেশীয় মানুষদের ভিড়। ইংরেজদের আগমনের আগেও কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায় চণ্ডীমঙ্গল বা মনসামঙ্গলের মত প্রাচীন কাব্যগ্রন্থগুলিতে। যদিও সেকালের কলকাতা মহানগর নয়। সামান্য এক পাড়াগাঁ। ইংরেজদের আগমনের আগে এই শহরে ছিল বাঘ, ডাকাত আর ঠ্যাঙাড়ের উপদ্রব। তবে জায়গায় জায়গায় প্রয়োজন অনুযায়ী আদিগঙ্গার পাড় বরাবর বসত সেইসব হাট। প্রাচীন কাব্য চণ্ডী থেকে প্রাসঙ্গিক কয়েক লাইন তুলে আনলাম সকলের জন্য-
ধালিপাড়া, মহাস্থান
কলিকাতা কুচিনান
দুই কূলে বসাইয়া বাট
পাষাণে রচিত ঘাট,
দুকূলে যাত্রীর নাট
কিঙ্করে বসায় নানা হাট।
১৪৯৫ খ্রীস্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাই রচিত মনসামঙ্গলেও কলকাতার বিভিন্ন স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। আজও তার কপি এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরীতে পাওয়া যাবে। সিংহলে নিজের বাণিজ্যতরী নিয়ে ব্যবসা করতে যাওয়ার পথে চাঁদ বণিক কালীঘাট, চিতপুর ছুঁয়ে আদিগঙ্গা ধরে যাচ্ছেন সেই পরিচয় পাওয়া যায়। আবার কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে কলকাতা সম্বন্ধে বলা হয়েছে –
ত্বরায় চলিল তরী তিলেক না রয়
চিতপুর শালিখা সে এড়াইয়া যায়
কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা
বেরোড়েতে উত্তরিল অবসান বেলা
…………..
কালীঘাট এড়াইল বেনিয়ার বালা
কালীঘাটে গেল ডিঙ্গা অবসান বেলা।

সুতরাং কলকাতার জন্ম ১৬৯০ সালের ২৪ শে আগষ্ট, এই দাবী যে ভিত্তিহীন সেকথা বেশ স্পষ্ট। শুধু তাই নয়। কলকাতার প্রাচীনত্ব নির্ধারণে বহু প্রামাণ্য তথ্য এই সিদ্ধান্তেই শিলমোহর দেয়। ইংরেজদের হাতে কলকাতা নামক একটি পাড়াগাঁ যে সম্ভ্রান্ত মহানগরীতে পরিণত হয়েছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কলকাতার ভৌগোলিক অবস্থান জব চার্নকের আগমনের বহু আগেই এবং তা রমরম করেই। বর্তমান সেন্ট জোনস্ গীর্জায় একজন জনৈক আর্মেনিয়ান মহিলা রেজাবীবেহ সুকিয়ার সমাধি পাওয়া যায়। তাঁর মৃত্যু হয় ১৬৩০ খ্রীষ্টাব্দের। কলকাতায় গঙ্গার পাড়ে জব চার্নকের পা পড়ার অনেক আগেই এখানে ব্যবসা একরকম জমিয়ে ফেলেছিলেন ককেশাস পার্বত্য এলাকার আর্মেনিয় অধিবাসীরা। কিন্তু পরবর্তীতে ব্রিটিশদের দাপটে একরকম সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীর তকমা জোটে তাঁদের। আজও কলকাতার মাটিতে আর্মেনিয়দের বানানো ‘চার্চ অব দ্যা হোলি নাজারেথ’ সবচেয়ে প্রাচীন গীর্জা বলে অভিহিত হয়ে আসছে। তাই বলাই বাহুল্য, কলকাতা শহর ব্রিটিশদের প্রীতিধন্য হলেও জন্মসূত্রে বহু প্রাচীন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।