–” খাইসে, একা রামে রক্ষা নাই সুগ্রীব দোসর ! ”
সুন্দর আবহটাকে খানখান করে দিয়ে একটা —ভগ্নদূতের মতো ধ্রুবদা হাজির হলেন।
—” তুই তাইলে এইখানে? নাগাবাবার লগে বইস্যা গাঁজা টানতাসিস ! আর আমি ব্যাবাক শ্মশান খুঁইজ্যা মরি? আইচ্ছা কানাইদা, তোমার কি হগগল বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাইলো? তোমার মনে নাই , গেলো বার গাঁজা খাইয়া অর কী অবস্থা হইসিলো, অরে আবার টানাইলা? ”
–” আমাকে কেউ এটা খেতে মাথার দিব্যি দেয়নি ধ্রুবদা, আমার নিজের ইচ্ছাতেই আমি খেয়েছি। আমায় খুঁজছিলে? কেন? ”
–” ক্যান আবার, সোনাদায় তো আর খ্যাটন বগলে নিয়া সারাটাদিন বইস্যা থাকবো না, তেনারে তো মুক্তি দিতে হইবো! যদি অবশ্য খাওন না লাগে তো… “
কথাটা বলেই ধ্রুবদা পেছন ফিরে হাঁটা লাগালেন।
–” মুসাফির, এক বাত শুনো তো সহি, এ্যায়সা কোই রাখ না হো যাহা পেয়ার না হো, এ্যায়সা কোই আগ না হো যাহা পানি না হো। ধ্রুববাবু, তোমার উষ্মার ভেতরেই তো ভালোবাসা প্রকাশ পেলো গো। ”
ধ্রুবদা ফিরে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এলেন ফের।
–” আপনের লগে এইখানেই তো মুশকিল, এমন একটা কথা কইয়া ফেলেন যে তার কোনও উত্তর দেওনের থাকে না। আইচ্ছা আপনেই কন, বেলা কয়টা হইসে? খালি প্যাটে শুধু তামাক খাইলে হ্যার পরে তো চোখে জল ঢালতে হইবো। হক্কলে মিইল্যা শ্যাষে ধরাধরি কইর্যা… ”
–” এবার কিন্তু তোমার সাথে একেবারেই বসা হলো না, ধ্রুববাবু। চলো হে গোঁসাই, পেটেও যেন প্রেমের সুর উঠেছে। ”
— ” আচ্চা ধুবদাদা, তুমি আমার ওপর গোঁসা করেচো কেনে, বইলবে এট্টু? এসে ইস্তক দেকতিচি, কেমুন যেন গরগর করতে নেগেচো, আমি কি কিচু ভুল কইরে বইসলাম গো? “
হঠাৎ করেই কানাইদা কথাটা বলে উঠলেন। এভাবে যে কথাটা উঠবে, সেটা ধ্রুবদাও ঠিক আঁচ করে উঠতে পারেনি। কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলেন ধ্রুবদা। একেবারে অপ্রস্তুতের মতো হয়ে তোতলাতে লাগলেন।
–” গোঁসা! মানে আমি! মানে তোমার উপর, তোমাদের উপর গোঁসা করসি? ক্যান? গোঁসা করুম ক্যান, তোমাগো উপরে আমি, মানে — আমি তো কিস্যু বুইঝ্যা উঠতে পারতাসি না গো কানাইদা, একটু বুঝাইয়া কও দেখি? ”
–” সেই যে তুমি আমাদের আখড়া থেকে এলে, সে ইস্তক একবারের জন্যও কোনো কথা বললে না, এখন এখানে এলে, এসেই কোনও কিছু না জেনে না বুজে আমাকে… ”
—” এই দেখো, এমন কি কইসি কও দেখি? কইলাম যে তুমি তো জানো যে গতবার পোলাটায় সামান্য একটু নেশা কইর্যা কেমন ভিরমি খাইয়া পড়সিলো, ও তো এইসব নেশা ভাঙ কিছু করে না, খাইলে পরেই চিত্তির হইয়া পড়বোনে, আর সক্কলরে ব্যস্ত কইরা… ”
–” আখড়ায় গিয়েও তুমি অকারণে এমন একটা কতা বইললে যে কিষ্ণভামী দোর দে বইসে সমানে কেঁদে ভাসাচ্চে। ”
–” আমি! ”
ধ্রুবদা যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
–” আমি বাজে কথা কইসি? বোনের মনে দুঃখ দিসি? ক্যান? কি এমন কথাটা কইসি কও দেখি? এইর লিগ্যাই হেরে এইখানে দেখতাসি না। দ্যাখসো, কিস্যু মনে পড়তাসে না গো কানাইদা, কী কইসিলাম কও দেখি? ”
–” তোমার মনে নেই? কেন শুধুশুধু মিথ্যে কথা বলছো ধ্রুবদা ? ”
আমার চুপ করে থাকাটা অসহ্য মনে হচ্ছিলো। এটাও হয় নাকি যে, ধ্রুবদা সবকিছু ভুলে মেরে দিয়েছেন? আমার গায়ের ওপর থেকে কাঁথা টান মেরে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে আমি ওখানে রাত কাটালাম কেন, তার কৈফিয়ত চেয়েছিলেন।
–” ওই, তুই চুপ কর, বড়োগো কথার মধ্যিখানে নাক গলাস ক্যান? ”
–” মানে ! তুমি যখন আমায় বলেছিলে তখন আমারও তো নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেওয়ার দায় থেকে যায়। আমি কানাইদার আখড়ায় রাত কাটিয়েছি কেন, সেকথা চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করোনি? বলোনি যে ওরা যাদু জানেন, বশীকরণ জানেন? ”
ধ্রুবদা কেমন যেন গুটিয়ে গেলেন। কানাইদা মাথা নীচু করে বসে আছেন, আর নাগাবাবা কী করবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না।
— ” হ, এই কথাগুলি এইভাবে কওন আমার ঠিক হয় নাই, চলো দেহি কানাইদা, কিষ্ণভামার কাসে গিয়া ক্ষমা চাইয়া আসি। ”
–” এখন আর অন্য কোথাও না, পেটের কলকলানি উদারা, মুদারা ছাড়িয়ে একদম তারায় গিয়ে নাড়া বেঁধেছে। আগে চলুন খেয়ে নেওয়া যাক, তারপর না হয় মাথা ঠান্ডা করে কিছু একটা ভাববেন সবাই। ”
নাগাবাবার এই কথাটা এ মূহূুর্তে খুবই প্রয়োজন ছিলো। সবাই মিলে উঠে দাঁড়ালাম। এতো দূর থেকেও সোনাবাবার হাতা খুন্তি, হাঁড়ি কড়াইয়ের আওয়াজ শোনা গেলো।