১৬ জুন ১৯৪১
নৃতত্ববিদ মিখাইল গেরাসিমোভের নেতৃত্বে রুশ দলটা অবশেষে সফল হল। পাঁচশো বছরের পুরনো কফিনের ঢাকনাটা খুলতেই নেশা ধরানো একটা গন্ধ ধাক্কা দিল মগজে। কয়েক মুহূর্তের ঝিমকিনি কাটিয়ে কফিনের দিকে তাকাতেই চোখ গেল পারসিক লিপিটার দিকে। সাবধানবাণী – ‘আমার সমাধি যে খুলবে সে আমার থেকেও বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে।’
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন গেরাসিমোভ। স্থানীয় কুসংস্কারের কারণ তাহলে এই লিপি। এর জন্যেই সমরখন্দের বাসিন্দারা আমিরের কবর খোঁজায় বাধা দিয়েছিল। রুশ সেনার চাবুক খেয়ে সিধে হয়েছে। সেই দিনই বিশ্বের অন্যতম সফল হানাদার আর বৃহত্তম সাম্রাজ্যের মালিকের দেহ প্লেনে তুলে মস্কো রওনা দিলেন পণ্ডিতের দল। সেটা ১৬ জুন ১৯৪১।
এর তিন দিন পর ১৯ জুন বার্লিনে বসে অপারেশন বার্বারোসা শুরুর নির্দেশ দিল হিটলার। ব্লিৎসক্রিগ বা ঝটিকা আক্রমণের মুখে পড়ে পোকামাকড়ের মত মরতে শুরু করলেন রাশিয়ার মানুষ। ৫০০ বছর আগে দিল্লি থেকে বসফরাস পর্যন্ত এমন ঘটনা বহুবার ঘটিয়েছেন সমরখন্দের আমির তিমুর।
২৮ জুলাই ১৪০২
সকাল ১০টা। পাহাড়ের ঢাল থেকে নিচের উপত্যকাটার দিকে তাকালেন ৬৬ বছরের বৃদ্ধ। বিস্তৃত চিবুকাবাদ উপত্যকার ওপর অশুভ একটা কালো ছায়ার মত দাগ। কালো পোশাক পরা অন্তত দু লক্ষ মানুষ। আর্মেনিয়া থেকে আফগানিস্তান, সমরখন্দ থেকে সাইবেরিয়া, দিল্লি থেকে দামাস্কাস – জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে প্রস্তুতির ত্রুটি রাখেননি বহু যুদ্ধের পোড় খাওয়া সেনানায়ক। গত তিন দশক ধরে বাছা বাছা সেনার এই বাহিনী স্তেপ ভূমি থেকে পর্বত, মরুভূমি থেকে সবুজ শস্যক্ষেত দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তিন পুরুষ ধরে আমিরের কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়ে যাওয়া এই বাহিনীর সামনে এক এক করে পতন হয়েছে শহরের পর শহরের। অ্যান্টিওক আর অ্যালেপ্পো, বালখ আর বাগদাদ, দিল্লি আর দামাস্কাস, হিরাট, কাবুল, শিরাজ, ইসফাহান … একের পর এক চোখ ধাঁধানো শহর পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। যুদ্ধে জিতে প্রতিপক্ষের কাটা মাথা দিয়ে পর পর পিরামিড সাজিয়ে দেওয়া ছিল অপ্রতিরোধ্য তাতার বাহিনীর বিজয়োৎসব পালনের পদ্ধতি। তার পর তারা ঢুকত শহরে। অবর্ণনীয় হত্যালীলা, বেপরোয়া লুঠ, অবাধ ধর্ষণ অার বেলাগাম অগ্নিসংযোগ – বহু বছরের চেষ্টায় গড়ে তোলা শহর মাটিতে মিশে যেত কয়েক ঘন্টার মধ্যেই।
২৮ জুলাইয়ের ওই সকালে পাহাড়ের ঢালে অপেক্ষায় থাকা সম্রাটের দিকে তাকিয়ে অতীতের দিনগুলোর কথাই ভাবছিল সেনার দল। ততক্ষণে প্রায় পঙ্গু শরীরটা কোনও রকমে ঘোড়া থেকে নামিয়ে সর্ব শক্তিমানের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা শেষ করেছেন তৈমুর। চিবুকাবাদের প্রান্তরে সেদিন তৈমুরের বিপুল বাহিনীর বাঁদিক ছিল তাঁর এক পুত্র শাহরুখ আর নাতি খলিল সুলতানের অধীনে। বাহিনীর এই দিকের একেবারে সামনে ছিলেন তৈমুরের আর এক নাতি সুলতান হুসেন। বাহিনীর ডান দিকের দায়িত্বে ছিলেন আমিরের আর এক ছেলে মিরন শাহ। ডান দিকের সামনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন নাতি আবু বকর। সেনা বিভাজনের ব্যবস্থা আরও একবার দেখে নিয়ে খুশিই হলেন আমির। ঘোলাটে চোখ বাহিনীর অন্য দিকের তুলনায় মাঝখানে একটু বেশি সময় ঘোরা ফেরা করল। ওই অংশের দায়িত্বে আছেন আমিরের প্রিয় নাতি ও উত্তরাধিকারী মহম্মদ সুলতান।
উপত্যকার অন্য প্রান্তে প্রায় সমসংখ্যক সেনা নিয়ে তৈমুরলঙ্গের বাহিনীর দিকে তাকিয়েছিলেন ‘ইসলামের তরবারি’ অটোমান সুলতান প্রথম বায়াজিদ। এশিয়া মাইনরের বিভিন্ন অংশ থেকে লড়াকু সেনা নিয়ে তাঁর বাহিনী তৈরি। এ ছাড়াও অটোমান বাহিনীতে রয়েছে ২০ হাজার সার্বিয়ান ঘোড়সওয়ার। বাহিনীর মাঝখানে রয়েছেন সুলতান নিজে। সঙ্গে তাঁর তিন ছেলে ইশা, মুসা আর মোস্তাফা। ডান দিকের দায়িত্বে সুলতানের শ্যালক সার্বিয়ার স্তেফান লাজারোভিচ। বাঁদিক দেখছেন সুলতানের আর এক ছেলে সুলেমান চেলেবি। এই বাহিনীই ছ বছর আগে শেষ ক্রুসেডে নিকোপলিসের যুদ্ধে খ্রিস্টান বাহিনীকে উড়িয়ে দিয়েছিল।
সেদিন সূর্যাস্তে অঙ্কারার যুদ্ধ শেষ হল। অস্তে গেল সুলতান বায়াজিদের রাজনৈতিক জীবন। তাতার বাহিনী যখন অটোমান সেনার কাটা মুন্ডু দিয়ে পিরামিড তৈরিতে ব্যস্ত, ততক্ষণে যুবরাজ সুলেমান চেলেবি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে লম্বা দিয়েছেন। লড়াই শুরুর কিছুক্ষনের মধ্যেই সুলেমান বুঝে গিয়েছিলেন আজ তৈমুরকে আটকান যাবে না।
চিবুকাবাদে লড়াই জিতে সুলতান বায়াজিদকে সোনার খাঁচায় ভরে বাদাম পেস্তা খাওয়াতে খাওয়াতে সমরখন্দ নিয়ে এসেছিলেন তৈমুর।
জুলাইতে চিবুকাবাদ আর পাঁচ মাস পর ডিসেম্বরে বন্দর শহর স্মিরনা … পারসিক ঐতিহাসিক শরাফ উদ দিন আলী ইয়াজদি এবং সিরিয়ার আহমদ বিন আরবশাহ লিখেছেন স্মিরনা দখলের সময় নিহত নাইটদের কাটা মাথা কেল্লার মধ্যে ছুঁড়ে ফেরত পাঠিয়ে নিষ্ঠুরতাকে আলাদা উচ্চতায় নিয়ে যান তৈমুর। প্রথমে চিবুকাবাদ, তারপর স্মিরনা – বসফরাসের ওপর দাঁড়িয়ে তৈমুর যখন ইউরোপের দিকে তাকালেন, গোটা ইউরোপের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। উন্মত্ত এই তাতারদের আটকাবে কে! কিন্তু সেবার ইউরোপ দখলের কোনও পরিকল্পনা ছিল না আমিরের। বন্দী বায়াজিদকে নিয়ে ফিরে গেলেন নিজের দেশে।
তুরস্ক থেকে ইরান পর্যন্ত দখলে আনার পর ১৪০৫ সালে ফের রাজ্যবিস্তারে বেরোলেন তৈমুর। এবার পুবদিকে। চিনে মিং বংশীয় রাজাদের সর্বনাশ করতে। কিন্তু অভিযান শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই মারা গেলেন ইসলামের চাবুক তৈমুর। পচন আটকানোর জন্য তাঁর দেহ সুগন্ধী রাসায়নিক মলম মাখিয়ে ফেরত আনা হল সমরখন্দে। সমারহে সমাহিত করা হল। পরের ৫০০ বছরে মানুষের স্মৃতি থেকে ওই সমাধির ঠিকানা বিলকুল লোপ পেয়ে গেল।
উজবেকিস্তান সোভিয়েত অধিকারে আসার পর শুরু হল আমির তিমুরের সমাধি খোঁজার কাজ। তিমুরের প্রতি জোসেফ স্ট্যালিনের আগ্রহ ক্রমশ অবসেশনের জায়গায় পৌঁছেছিল। সমাধি খুঁজে বার করে তিমুরের দেহ মস্কো নিয়ে আসতে নৃতত্ত্ববিদ মিখাইল গেরাসিমোভের নেতৃত্বে একটা দল তৈরি হল।
অনুসন্ধান শুরু পর পুরোনো পুথিপত্র থেকে পাওয়া বিভিন্ন হদিস বাতিল করতে করতে প্রায় হল ছাড়ার উপক্রম হয়েছিল ওই দলের। বেশ কয়েক মাস ধরে উজবেকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় আমির তিমুর বা তৈমুরলঙ্গের সমাধি খুঁজছিলেন ওঁরা। অবশেষে খোঁজ মিলল। তারপর কফিনের ডালা খুলে ওই ভয়ানক সতর্কবার্তা।
হিটলারের রাশিয়া আক্রমণে প্রথমে নাৎসি বাহিনীর সামনে ঝড়ের মুখে খড়কুটোর মত উড়ে গেল লাল ফৌজ। তিমুরের কফিনের কথা মনে করে স্ট্যালিনের সঙ্গে দেখা করার মরিয়া চেষ্টা শুরু করলেন গেরাসিমোভ। অবশেষে ১৯৪২ এর নভেম্বরে দেখা হল। তিমুরের কফিনের ওই বার্তার কথা স্ট্যালিনকে জানালেন নৃতত্ত্ববিদ। সব দিক বিবেচনা করে আমিরের দেহ ফের সমরখন্দ পাঠিয়ে পূর্ণ ইসলামি মর্যাদায় আবার সমাহিত করার নির্দেশ দিলেন। তৎক্ষণাৎ সেই নির্দেশ পালিত হল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ছবিটা বদলে গেল। স্ট্যালিনগ্রাদে পরাজিত হল নাৎসি বাহিনী। তিন বছরের মধ্যে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হল জার্মান সেনা।