গারো পাহাড়ের গদ্যে জিয়াউল হক

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শাহাদৎ হোসেন

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শাহাদৎ হোসেন, এফ.এফ. ভারতীয় তালিকা নম্বর-৩৭৬১৬, গেজেট নম্বর যশোর সদর-০৪৫, লাল মুক্তিবার্তা নম্বর-০৪০৫০১০১১৬, সমন্বিত তালিকা নম্বর-০১৪১০০০২০৭৩, মোবাইল নম্বর-০১৭১২৭৬৮২৬৭, পিতা ঃ শাহাবউদ্দিন বিশ্বাস, মাতা ঃ রহিমা খাতুন, স্থায়ী ঠিকানা ঃ গ্রাম ও ডাকঘর ঃ হালসা, উপজেলা ঃ যশোর সদর, জেলা ঃ যশোর। বর্তমান ঠিকানা ঃ ঐ।
৩ ছেলে ৪ মেয়ের মধ্যে শাহাদৎ হোসেন ছিলেন বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। ১৯৭১ সালে যশোর সদর থানার দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পর পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় দেশের অবস্থা দিন দিন উত্তপ্ত হতে থাকে। ইয়াহিয়া খানের এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে দেশের আপামর মানুষ রাস্তায় নেমে এসে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচন্ড গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। অফিস, আদালত, কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। স্কুল বন্ধ থাকায় শাহাদৎ হোসেন পড়ার টেবিল ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসে মিটিং ও মিঠিলে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। আন্দোলনের পরবতর্ী কর্মসূচি ঘোষণার জন্য ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক বিশাল জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন। তিনি তার ভাষণে ঘরে গরে দুর্গ গড়ে তুলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুকে মোকাবেলার আহবান জানান। বঙ্গবন্ধুর এই আহবানের পর শাহাদৎ হোসেনসহ সারা বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সারা দেশে সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
অবস্থা বেগতিক দেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু আলোচনায় ইতিবাচক ফলাফল না আসায় সেনাবাহিনীকে বাঙালিদের উপর আক্রমনের নির্দেশ প্রদান করে ২৪ মার্চ বিকেলে ঢাকা ছেড়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। প্রেসিডেন্টের নির্দেশ মোতাবেক সেই দিন রাত থেকেই পাকিস্তানি সেনারা সারা বাংলাদেশের উপর আক্রমণ করে মানুষ হত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চ সকাল থেকেই যশোর একলাকার বিপ্লবী জনতা শহরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। ২৭ মার্চ আশে পাশের গ্রামের হাজার হাজার সাধারণ জনতা বাঁশের লাঠি ও দেসীয় অস্ত্র হাতে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে নিত্য ব্যাবহার্য জিনিষপত্রের সরবরাহ বন্ধ করে দেন। ২৮ মার্চ শত্রুসেনারা যশোর শহরে এসে বিক্ষোভরত জনতার উপর গুলিবর্ষণ করলে বেশ কিছু সাধারণ মানুষ নিহত হন। সীমান্ত এলাকায় দায়িত্ব পালন করে ৩০ মার্চ রাতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা ক্যান্টমেন্টে ফিরে আসার পর তাদের অস্ত্র জমা নিয়ে পরের দিন ভোর বেলায় পাঞ্জাব ও বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা নিরস্ত্র বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের উপর অতির্কিতে আক্রমণ চালায়। সেই আক্রমণে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অসংখ্য সেনা শহিদ হন। কিছু ভাগ্যবান সেনা কোন মতে প্রাণ বাঁচিয়ে ক্যান্টমেন্টের বাইরে যেতে সক্ষম হন। পরের দিন সকাল বেলা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সুবেদার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ২০/২৫ জন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য প্রাণ বাঁচিয়ে কোন মতে হালসা গ্রামে এসে হাজির হন। গ্রামে সেবাযত্ন ও খাবার পরিবেশনের পর শাহাদৎ হোসেন ও তার বন্ধুরা ঘোড়ার গাড়িতে করে তাদের ভারতের বয়রা বিএসএফ ক্যাম্পে পৌছিয়ে দিয়ে আসেন।
ইতোমধ্যে পাকিস্তানি সেনারা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার শাদহৎ হোসেনদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার পর এপ্রিল মাসের ২০ তারিখে রমুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য তিনি ভারতের পথে যাত্রা করেন। তারপর বাংলাদেশের বর্ডার পর হয়ে ভারতের বনগাঁ গিয়ে বি.এস. ক্লাব মাঠের মধ্যে টাঁঙানো অস্থায়ী তাঁবুতে থাকা শুরু করেন। তারপর টালিখোলা ইয়ুথ ক্যাম্প খোলার পর সেখানে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী লেঃ মতিউর রহমান। সেখানে দেড় মাস অবস্থান করার পর মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বাছাই করে শাহাদৎ হোসেনদের বিহার রাজ্যের চাকুলয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়। সেখানে ২৫ দিন প্রশিক্ষণ শেষে ৮ নম্বর সেক্টর হেডকোয়য়ার্টার কল্যানি হয়ে তাদের পেট্রাপোল ভারতীয় সেনা ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়। এই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন ভারতীয় ৭ পাঞ্জাবের সিইও বাজুরা সিং। সেখানে অবস্থান কালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর মন্জুরের সাথে দেখা হয়। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জানান যে দেশমাতৃতাকে শত্রুমুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছি। আমাকে সব সময় তোমাদের পাশে পাবে। এরপর শাহাদৎ হোসেনের নেতৃত্বে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধার একটা গ্রুপ গঠন করে তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রদান করা হয়। তারপর তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ঝিকরগাছা থানার কায়েমখোলা গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করেন।
কায়েমখোলা গ্রামে অবস্থান কালে একদিন যশোর, ঝিকরগাছা ও ছুটিপুর ডিফেন্স থেকে পাকিস্তানি সেনারা এসে ৩ দিকে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কায়েমপুর ক্যাম্পের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে। এতো বিশাল শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন মতেই টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। তাই তারা সাময়িক ভাবে পিছু হটে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গরিবপুরের যুদ্ধ ঃ মুক্তিযোদ্ধাদের সেল্টার ছিল গরীবপুর থেকে ৩ মাইল দূরে ধূলিয়ানী গ্রামে। অন্যদিকে শত্রুসেনাদের ক্যাম্প ছিল সেখান থেকে আরও ৩ মাইল দূরে চৌগাছাতে। চৌগাছা থেকে শত্রুরা সন্মুখ দিকে অগ্রসর হলে পথিমধ্যে গরীবপুর ও জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে তাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ৩ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও ৪/৫ জন আহত হয়। অন্যদিকে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ১ জন জীবিত ধরা পড়েন। তারপর শাহাদৎ হোসেনকে আগরতলা মামলার ১৪ নম্বর আসামী মেজর হুদার অধীনে বয়রা ক্যাম্পে বদলী করা হয়। মেজর হুদা তখন শাহাদৎ হোনেসনসহ ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি সেনাদের ছুটিপুর ও চৌগাছা ডিফেন্সের উপর নজর রাখার দায়িত্ব প্রদান করেন। নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বয়রা ক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা ব্যাটেলিয়ন এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেই ব্যাটেলিয়নের টু-আইসি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর অমল মুখাজর্ী।
২৫ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় ব্যাটেলিয়নটি ট্যাঙ্ক বহর দিয়ে সন্মুখ দিকে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বর্ণি ও কচুবিলা ডিফেন্সের উপর আক্রমণ শুরু করেন। বিকাল থেকে শত্রুসেনারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। সারা রাত যুদ্ধ চলার পর ভোর রাতের দিকে শত্রুসেনারা পিছু হটে যায়। সন্মুখ দিকে অগ্রসর হয়ে চৌগাছা পৌছানোর পর পাকিস্তানি বিমান বাহিনী মিত্রবাহিনী বাহিনীর উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে শত্রুদের ২টি বিমান ধ্বংস হয়। বাকি ২ টি পালিয়ে যায়। মিত্রবাহিনী তখন পাকিস্তানি সেনাদের পুলিগ্রাম ও বুরিন্ডিয়া ডিফেন্সের মাঝখানে মৎসডাঙ্গা গ্রামে ডিফেন্স গড়ে তোলেন। পরের দিন ভোর বেলা শত্রুসেনারা মর্টারের গোলা বর্ষণ শুরু করে। সেই সময় কায়েমখোলা থেকে শত্রুদের ছোড়া একটি সেলের আঘাতে মেজর মুখাজী আহত হন। সেখান থেকে আহত মেজর মুখাজীকে বয়রা হয়ে কলকাতায় প্রেরণ করা হয়। ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে খুলনার দিকে পালিয়ে যাওয়ার পর এই অ লের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয়। তারপর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে শাহাদৎ হোসেনদের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিল বলেই আজ আমরা অর্থনৈতিক ভাবে সফল হয়ে মধ্যম আয়ের দেশে যুক্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌছে গেছি।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *