ক্যাফে গল্পে যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা

ভালোবাসার জন্য আরও সহস্র মাইল

এই খুঁটে খাওয়া জীবন, এই ফেলাছাড়া জীবন – তোমাকে ভালোবাসি। শীতের কামড়ে শুকিয়ে আসা জলের ধারে কাদায় পাঁকে ঘুরে ঘুরে এক ডাহুক যা সন্ধান করে চলেছে, তারও নাম জীবন। যে মাছটা মাছরাঙার ঠোঁট থেকে খসে পড়ে জলে ফিরে গেল, সে আর একবার জীবনের জয় ঘোষণা করল। আর অবশেষে হার না মানা জেদে একটি কুচো মাছ চঞ্চুতে শিকার করে জীবনের আর একটা উৎসব সম্পন্ন করল ডাহুকটি তার নিভৃত প্রাণের অন্তরালে। তাই, ওই মরণপণ জীবন, ওই সন্ধানী জীবন – তোমাকে ভালোবাসি।

শীতের মাঠে সোনালি খড়ের চূড়ো, খড়ের জটায় সোনার ধান। তাকে সামনে রেখে প্রতিনিয়ত মরণ আর জীবনের লড়াই চলছে।যেভাবে চলে ইঁদুর ও প্যাঁচার নিয়ত লুকোচুরি! ইঁদুর সোনালি ধানে পায় পুষ্টি, তার পুষ্ট শরীরের লোভে ওৎ পেতে থাকে রাতের পেঁচা। সবাই মরণকে থামতে বলে জীবনের সঞ্চয় সেরে নেয়। গোধূলিতে কুয়াশা জমে মাঠে প্রান্তরে, নদী আচমন সেরে সেই কুয়াশার ওড়নায় মুখ মুছে নেয়, সেখানে রহস্যের আড়ালে কীসের যেন আয়োজন চলে! যেন বোয়ালের মতো লাফ দ্যায় অন্য এক জীবন। একফালি বিষণ্ণ চাঁদের লকেট আকাশের বুকে, তার পাশে নশ্বরতার বোধ জাগিয়ে এক বিন্দু নক্ষত্র এসে দাঁড়ায়। খড়ের গায়ে শিশির ঝরে পড়ছে, সে অতীব মিহি ও অদৃশ্য হলেও কিছু পরে আঙুলের ডগা তাতে সিক্ত হয়। এভাবেই হয়তো ওই খড়ে, শিশিরে, ধানে, চাঁদে, নক্ষত্রে অদৃশ্য থেকে মুছে যাওয়া মানুষেরা রয়ে যায়!

শিশির পতনের শব্দে সেই সব মানুষেরা ডাকে, বলে – এই যে – এই যে, মনে পড়ে? শান্ত জল, তলে তলে বালুকণায় ইশারার কম্পন তুলে বয়ে যাওয়া জল, শ্মশান ধোওয়া জল – মনে আছে? জলের ধারে জলজ ফুল, সাদা হাঁসের হলুদ পা – আমি ছিলাম কিন্তু! – মনে রেখো!

মনে রেখো – রাস্তার বাঁক থেকে ধুলোভরা হাত তুলে অতীত হাঁক ছাড়ে বর্তমানকে। মনে রেখো – বর্তমান চটিতে পা গলাতে গলাতে ভবিষ্যতের দিকে আকুতিভরা চোখ তুলে তাকায়। এই আকিঞ্চন জীবনের প্রতি। আকিঞ্চন আছে বলেই আমরা ভালোবাসি।

তোমাকে ভালোবাসি বলে জীবন হে –
ধুলোমাটি – আকাশের তারা, কোপাইএর ধারা ভালোবাসি
বাবুইএর বাসা, পাখিদের ভাষা ভালোবাসি
মানুষের ঘর, পাহাড়ি নির্ঝর ভালোবাসি
ঘাস আর গাছেদের আত্মায় লেগে থাকা স্নেহজল – ফুলে বসা মধুপের কলকল, ভালোবাসি
দাঁড়ি কমাহীন ভালোবাসি

ঘুনসী পরা ধুলোমাখা ন্যাংটো শিশু হাত বাড়িয়ে মায়ের কাছে ছুটে আসে।জীবন সেখানেও থেমে নেই। অভুক্ত মার্জার কেঁদে কেঁদে নোংরা নর্দমা লাফ দিয়ে পাড় হয়। তেমনই ভিক্ষাপাত্র হাতে ভেতরকান্নার ভিখিরিও জীবনের কাছে হাত পাতে। কানা – খোঁড়া – নুলো – রাস্তার পাগল – অনাথ শিশু – নষ্টভ্রূণ – সবাই জীবন চায়। হাওয়ার ঝাপট লাগে সমুদ্রের গায়। লাফ দিয়ে ভেসে ওঠে তৈলনিষিক্ত হাঙর। সবাই জীবন ভালোবাসে। তবু – তবুও ভালোবাসাকে মানুষ দু-পায়ে মাড়িয়ে যায় বলে সমুদ্র একদিন পাথর হয়ে ফসিলের মুখ হবে। দেদার পাঁজর ফাটিয়ে ঘাস খুঁজে বেড়াবে প্রহরের ঘোড়া। নির্বিকারের আড়ালে তার শক্তি পুড়ে যাবে হাড়মাস জ্বলে। তারপরও হয়তো এ পৃথিবী বুকে পাথর বেঁধে হেঁটে যাবে আরও সহস্র মাইল, অনাগত ভালোবাসার টানে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।