এক মাসের গপ্পে জাহ্নবী ব্যানার্জী (পর্ব – ৩)

নীলাঞ্জনা

(৩য় পর্ব)

রাত ১০ টা। আজই এরকম বৃষ্টি নামতে হল? কাল ভোর ৪ টের মধ্যে নীলের বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই হবে। কিংশুক ঠিক করেছিলো আজ রাত ১২.৪০ এর ফার্স্ট ট্রেন ধরে চলে যাবে। রাত থাকতেই নীলের কাছে পৌঁছে যাবে। কোনমতেই অন্যরকম কিছু হতে দেওয়া যাবে না। একবার ডঃ সেনকে ফোন করে নিলে হয়তো ভালো হত। যদিও রাত প্রায় বেশ হল, কিন্তু ডঃ সেন নীলের কেসটায় কেমন জড়িয়ে পরেছেন। সেই প্রথম যেদিন নীল আর ও গিয়েছিলো ডঃ সেনের কাছে, সেদিনই ওনাকে দেখে কিংশুকের ভালোলেগে গিয়েছিলো। মনে হয়েছিলো, ভরসা করা যায়।
উনি বলেছিলেন, “তারপর? কেমন আছো?” নীল একগাল হেসে বলেছিল “খুব ভালো আছি জেঠু।” নীলের
ডাকখোঁজ বরাবরই খুব ভালো। খুব সহজে মানুষ নীলের কাছাকাছি চলে আসে। ডঃ সেন বলেছিল “তাহলে আর আমার কাছে আসার কি দরকার?” নীল যেন গল্প করতে বসেছে এমন ভাবে কথা বলছিল। খানিক বাদে উনি বলেন আমায় চেম্বার থেকে বেড়িয়ে বাইরে গিয়ে বসতে। তারও খানিক বাদে নীল বেড়িয়ে এল চেম্বার থেকে এবং ডঃ আমায় ডেকে পাঠালেন। পরবর্তী কবে আসতে হবে, জানিয়েও দিলেন।
ডঃ সেন বেশ নামী সাইকিয়াট্রিস্ট। নীল নিজেই এনার নম্বর খুঁজে বের করে বলেছিল, “কিংশুক আমি না সাইকিয়াট্রিস্ট কন্সাল্ট করতে চাই।” ততদিনে নীল আর অরিন্দমের মাঝে এক বিশাল ফারাক দেখা দিয়েছিলো। চোখের সামনে দেখছিলাম, দুই মেরু থেকে আসা দুই মানুষ কিভাবে নিজস্ব জগতে বাস করা শুরু করেছে। যে নীলাঞ্জনা দি বিয়ের পর গুছিয়ে বাগিয়ে সংসার শুরু করেছিলো, আমি কিছুদিন যাতায়াতের পর বুঝে গিয়েছিলাম তা এক্কেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে কোন কারণে। নিশ্চিত হয়েছিলাম নীলাঞ্জনা দি’র জন্মদিনের দিন সারপ্রাইজ দেব বলে চুপিচুপি দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিলাম ঠিক বিকেল ৫ টার সময়ে। বিকেল ৫টা নাগাদ নীলাঞ্জনা দি নিয়ম করে ঘরের দরজা খুলত মিনি লিলিকে খেতে দেওয়ার জন্য। ওরা নীলাঞ্জনা দি’র পাড়ার দুই হুলো। সেদিন দরজার বাইরে অপেক্ষা করার সময়ে যখন ভাবছি এই দরজা খুলবে এবার, ভিতর থেকে শুনলাম, নীলাঞ্জনা দির গলার স্বর।
“তুই কি ভাবছিস আমি চোখ বুজে থাকি? আমি কিন্তু সবটা জানি। শুধু মাত্র আমি নিজেকে যাতে বলতে পারি ১০০ ভাগ চেষ্টা আমি করেছিলাম তোর সাথে এক ছাদের তলায় কাটাতে… তাই প্রতিদিন একটু একটু করে চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেদিন আমার এই চেষ্টা শেষ হবে, যেদিন আমি নিজের কাছে প্রশ্ন করে উত্তর পাব, আমি সবটুকু চেষ্টা করে ফেলেছি, সেদিন হয় তুই থাকবি বা আমি থাকব…”
একবর্ণ বুঝতে পারিনি সেদিন নীলাঞ্জনা দি কি বলছে এসব। কথা শুনে মনে হলো অরিন্দম’কেই বলছে। কিন্ত কেন?আর অরিন্দম বাড়ি আছে?এসব ভাবতে ভাবতেই নীলাঞ্জনা দি দরজা খুলে আমায় দেখে আহ্লাদিত হয়ে “সেকিরে তুই!” আমি একটু থতমত খেয়ে বললাম “হ্যাপি বার্থ ডে নীলাঞ্জনা দি!”
নীলাঞ্জনা দি এক্কেবারে স্বাভাবিক! সেই একরকম উৎসাহে আমায় আদর আপ্যায়ন করা শুরু। কিন্তু আমার মন কেমন করছিলো। অরিন্দম তো বাড়ি নেই! আমি একবার নানা অছিলায় জিগ্যেস করলাম, “নীলাঞ্জনা দি, অরিন্দমকে ফোন করো না…কখন আসবে ও?” নীলাঞ্জনা দি খুব ক্যাসুয়ালি উত্তর দিলো “আরে আজ কিসব ক্লায়েন্ট মিট আছে… ফোন সাইলেন্টে আছে রে.. আমায় আগেই বলে গেছে আজ ফোন করলে ধরতে পারবে না…”
আমার মন আরও বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। সেদিনই ও বলেছিল আমায় সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কথা প্রথমবার।
এরপর মাস তিনেক আমি একটু ব্যাস্ত ছিলাম অফিস কাছারি নিয়ে। যাতায়াতও প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছিলো। সেদিনের ঘটনার পর আমি একটু ডিস্টার্বড ছিলাম কদিন। একদিন ছুটির দিনে হঠাৎ মনে হয়েছিলো নীলাঞ্জনা দি’র কথা। মাথায় ভিড় করে এসেছিলো সেদিনের দুশ্চিন্তা। একটা ফোন করে বলেছিলাম, “ফাঁকা আছো?”
নীলাঞ্জনা দি ফোন ধরে একইরকম উচ্ছ্বসিত গলায় বলেছিল “কিরে কেমন আছিস?” আমি বলেছিলাম “চলছে… একটু ব্যাস্ত ছিলাম গো..আসবো? আড্ডা মারবে?” হ্যাঁ… নীলাঞ্জনা দি’র সাথে আমার আড্ডার কোন শেষ ছিলোনা। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, আমাদের আড্ডার কোন টপিক থাকতো না নির্দিষ্ট। আমরা সুকুমার রায়, টেনিদা, ফেলুদা, সৌমিত্র, উত্তম কুমার, নকশাল বাড়ি আন্দলন – সব কিছু নিয়ে আড্ডা দিতে পারতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একসাথে সূর্যাস্ত দেখতে পারতাম, ফুল কি করে একরাতে ফুটে যায়, সেই রহস্য উদ্ঘাটন করবো বলে রাত জেগে ভোররাতে ছাদে ঘুমিয়ে পড়তে পারতাম। এহেন আড্ডায় আমি আর ও দুজনেই খুব উৎসাহী ছিলাম বরাবর!
ভাবলাম বলবে চিরাচরিত ভাবে, “হ্যাঁ… চলে আয়”! উল্টে বললো, “না… আসিস না… আমি কোথায় আসবো বল?”
আমি একটু থমকালেও বললাম, “কফি হাউসে আস তাহলে…”
সময়মত কফিহাউসে পৌঁছে দেখলাম নীলাঞ্জনা দি দাঁড়িয়ে আছে হাল্কা গোলাপি শাড়ি পরে। হাতে ঘড়ি, কানে খুব ছোট দুটো দুল, কপালে টিপ। কি যে মিষ্টি লাগছিলো ওকে সেদিন! দূর থেকে মনে হচ্ছিলো বিকেলের বইপাড়ায় ভোরবেলার একটুকরো আকাশ গোলাপি আভা মেখে দাঁড়িয়ে আছে। জানিনা কেন সেদিন প্রথমবার মনে হয়েছিলো অরিন্দম বড় ভাগ্যবান!
নীলাঞ্জনা দি’কে শাড়ি পরে দেখিনি তা নয়। কিন্তু তবু একটু অপ্রত্যাশিত লাগলো।
পিছন থেকে ডেকে বললাম, “কি গো… আজ শাড়ি?” হেসে বললও, “ইচ্ছা হল… পরলাম! চল উপরে যাই…”
উপরে গিয়ে আমাদের আজকের পেটেন্ট সীটে বসে গল্প শুরু করলাম। কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল নীলাঞ্জনা দি’কে। একটু নার্ভাস। নিজের সাজ নিয়ে। এমন তো নয় নীলাঞ্জনা দি। বরাবরই দেখে এসেছি ও নিজেকে নিয়ে এক্কেবারে সচেতন নয়। আজ কি হল! আমি বলেই বসলাম “কি হয়েছে তোমার? বরের অফিস যাবে নাকি দেখা করতে?” নীলাঞ্জনা দি’র অত সুন্দর চোখগুলো নিমেষে ঈগলের চোখ হয়ে গিয়েছিলো। হিসহিস করে বলে উঠেছিলো, “আমি ডিভোর্স’এর জন্য অ্যাপ্লাই করেছি।”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।