গল্পে ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

মেঘ নেমে এল আজ জানালার কাছে – “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে”

জামসেদপুর থেকে কলকাতার বাড়িতে রোজ ফোন করার সময় প্রথমেই জানতে চাই ওদিকে বৃষ্টি কেমন হচ্ছে। যখন এই প্রবন্ধ লিখতে বসেছি তখন ৩১শে জ্যৈষ্ঠ রাত সাড়ে ন’টা আর রাত পোহালেই আষাঢ়। তাই রবীন্দ্রনাথের মত বলতে ইচ্ছা করছে, “আবার এসেছে আষাঢ়, আকাশ ছেয়ে”। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, এবার বর্ষা সময়মত এসেছে এবং আগমণের ২৪ ঘন্টার মধ্যে রাজ্যের বেশির ভাগ জেলাতেই ঢুকে পড়েছে।
কিন্তু তারপর? রোমান্টিক বাঙালির বর্ষার প্রেম কিভাবে উৎযাপন হবে? যে কিনা বৃষ্টি ভিজে প্রকৃতির রূপে বিমোহিত হত। প্রেমিকার সঙ্গে ভিজে ওঠা অন্তরঙ্গতায় চপলতা ছড়িয়ে দিত। আজ করোনা এসে স্যোসাল ডিসটান্সিং এর নামে সব মানসিক ও শারিরীক তৃপ্তি লুঠ করে নিয়েছে। তবু বাঙালি ছাড়বার পাত্র নয়। কেউ মুখে মাস্ক পরে দুরত্ব বজায় রেখে প্লেটোনিক প্রেম এনজয় করছে আবার কেউ করোনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কালিদাসের মত করে তার সেই বিখ্যাত ছত্র উল্লেখ করছে “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে—”।
আর এই ছত্রটা উচ্চারণ করার পরেই মনে পড়ে সেই মেঘদূতম কাহিনী। ঘটনাটা একটা ছোট গল্পের মত। ধনের দেব কুবের। তার বাড়িতে চাকরি করে এক যক্ষ। ‘যক্ষ’ হলো লোকটির জাত-পাতের পরিচয়। যক্ষ বিয়ে করেছে সবেমাত্র। নতুন বৌ, ঘরসংসার গোছগাছ করায় যক্ষ ব্যস্ত। এর ফলে চাকরির কাজে বেচারার ত্রুটি ঘটতে লাগল। তখন রেগেমেগে কুবের তাকে শাস্তি দিলেন। তারা ছিল অলকাপুরীতে। অলকাপুরী হলো মানসসরোবরের কাছে কৈলাস পর্বতে এক শহর। কুবের তাকে সোজা পাঠিয়ে দিলেন রামগিরি পাহাড়ে। উত্তর প্রদেশের দক্ষিণাংশ ও মধ্যপ্রদেশের সংযোগস্থলে অত্যন্ত দূর ও দুর্গম পাহাড়ি জায়গাটি ঘন অরণ্যে ঢাকা। রাজধানী থেকে এসে এরকম বুনো জায়গায় এক বছর একা একা নির্বাসনে থাকবে যক্ষ- এটাই তার শাস্তি।
এর মধ্যে দশ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে, মাত্র দুটো মাস বাকি, তার পরেই সে ফিরে যেতে পারবে রাজধানী অলকাপুরীতে। এলো আষাঢ় মাস। বর্ষা কাল। মেঘের সে কী নয়ন-ভোলানো মনমাতানো রূপ! সমস্ত পর্বত ও অরণ্যানী নতুন সাজে সেজে উঠেছে যেন। দশটা মাস তার কোনো কষ্ট হয়নি, হঠাৎ এখন বাড়ির জন্য এমন মন কেমন করতে লাগল যক্ষের যে সে যেন পাগল হয়ে যায়। নববধূর জন্য কষ্ট হতে লাগল, শহুরে জীবনের আমোদ-আহ্লাদের জন্য শোক উথলে উঠল। তার ভয় হয়, বেচারি অভাগিনী বৌটি বেঁচে আছে তো। যক্ষ বেঁচে নেই ভেবে সে-ও যদি দুঃখ-শোকে মরে গিয়ে থাকে! সেকালে তো আর ডাকব্যবস্থা ছিল না যে যক্ষ স্ত্রীকে চিঠিপত্র লিখবে।
কী করে এখন! হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। আচ্ছা, মেঘ তো উড়ে উড়ে দেশ-দেশান্তরে যায়; যদি মেঘকে অনুনয়-বিনয় করে বলি যে, ‘ভাই মেঘ, তুমি আমার খবরটা আমার স্ত্রীকে একটু পৌঁছে দিয়ে এস’, তো সে যাবে না? যে বার্তা যক্ষ উত্তর মেঘকে পাঠিয়েছিল, –
তন্বী শ্যামা শিখরদশনা পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী
মধ্যে ক্ষামা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভিঃ
শ্রোণীভারাদলসগমনা স্তোকনম্রা স্তনাভ্যাং
যা তত্র স্যাদ্ যুবতিবিষযে সৃষ্টিরাদ্যেব ধাতুঃ
এটাই হলো ‘মেঘদূতম্’ কাব্যের কাহিনী। আর পূর্বমেঘে যক্ষমেঘকে বর্ণনা দিচ্ছে যক্ষ- কীভাবে কোন পথ দিয়ে মেঘ অলকাপুরীতে যাবে। আর উত্তরমেঘে যক্ষ বুঝিয়ে দিচ্ছে মেঘকে- রাজধানী অলকায় অত ঘরবাড়ি রাস্তাঘাটের ভেতরে মেঘ কী করে চিনে নেবে যক্ষপ্রিয়াকে, তার হদিস। মেঘকে দূত হিসাবে পাঠানো হয়েছে বলেই কাব্যটির নাম মেঘদূত।
নব পথে যাবে যবে প্রোষিতভর্তৃকা সবে লোচনাগ্রে পতিত অলক
উত্তোলিয়া তব পানে চাহিবে প্রেমের টানে; তুমি প্রিয়-বার্তা-সংবাহক।
সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাসের চূড়ান্ত নিদর্শন ‘মেঘদূত’ বা মেঘদূতম! বলা হয় এই কালজয়ী কাব্য গাঁথা রচনায় হাত দেন আষাঢ়ের প্রথম দিবসে। এইজন্য মেঘদূতকে বলা হয় “বর্ষাকাব্য”।
মেঘের মাধ্যমে বিরহিণী প্রিয়ার কাছে এক নির্বাসিত যক্ষের বার্তা প্রেরণ মেঘদূত কাব্যের উপজীব্য। পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ এ দুটি অংশে কাব্যটি বিভক্ত। কালিদাস সবিস্তারে মেঘের বিচিত্র যাত্রাপথের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন; শুষ্ক তৃষ্ণার্ত ভূমি, বিরহখিন্না প্রণয়িনীর মতো শীর্ণ অগভীর জলধারাগুলি মেঘের পথ চেয়ে আছে, পথ চেয়ে আছে পর্বতগুলিও তাদের প্রিয় বন্ধু বর্ষার মেঘের জন্য।
কালিদাস তখন কাব্য লিখতে শুরু করলেন—
‘অস্ত্যুত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা
হিমালয়ো নাম নগাধিরাজ।’
কখনও লিখলেন—
কশ্চিৎ কান্ত বিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ।’
অথবা
‘বাগার্থাবির সম্পৃক্তৌ বাগর্থ প্রতিপত্তয়ে।’
মন্দাক্রান্তা ছন্দে রচিত মেঘদূত কাব্যে রচিত হয়েছে মানুষের অতলস্পর্শী বিরহ। শুদ্ধ বিরহকে অবলম্বন করে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ কাব্য মেঘদূত। মেঘদূতের কাহিনী সরল অথচ কাব্যগুণ সমন্বিত; কর্তব্যে অসাবধানতায় প্রভুর অভিশাপে যক্ষকে রামগিরি পর্বতের বিজন আশ্রমে নির্বাসিত হতে হয়। সেখানে বসে আষাঢ়ের প্রথম দিবসে নববর্ষার মেঘ দেখে তারই মাধ্যমে অলকাপুরীর প্রাসাদে তাঁর বিরহী প্রিয়ার উদ্দেশে বার্তা প্রেরণ করবে বলে মনস্থির করে সে। প্রিয়ার রূপ বর্ণনায় বলে:
‘তৈলশূন্য কুন্তল জালে আয়ত লোচন পড়েছে ঢাকা,
অজ্ঞনহীন নয়ন প্রান্তে কটাক্ষবাণ নাহিক’ আঁকা;
মদির-অলস ভ্রু-বিলাস ভুলে মৃগাক্ষী মোর তোমার প্রাণে,
তুলি’ আঁখি দুটি চাহিবে যখন, স্পন্দন ঘন জাগিবে প্রাণে,
হয়ত ফুটিবে নয়নে তখন চাহনি চপল কৌতূহলে,
যেন চঞ্চল মীনদল ক্ষোভে আহত কমল কাঁপিছে জলে!’
বিরহের আতিশয্যে যক্ষের জড় ও জীবের ভেদাভেদজ্ঞান লুপ্ত হয়। মেঘকে সে জানাতে থাকে কোন কোন নগর, নদী ও পর্বত পেরিয়ে তাকে অলকায় পৌঁছতে হবে। উত্তর মেঘের উদ্দেশে সে বলে:
‘হে মেঘ, শোনো তবে
অলকার কথা বলি তোমায়
দীপ্তিময়ী ললনারা যেথা
বিদ্যুত্সম ঝলকি যায়।
হে মেঘ, ইন্দ্রধনু
তোমার সঙ্গে যেমন,
অলকার প্রাসাদে, প্রাসাদে
তেমন অনবদ্য চিত্রণ।’
কাব্যের এই অংশে প্রাচীন ভারতের এক অসামান্য ভৌগোলিক বিবরণ ফুটিয়ে তুলে মেঘকে অনুরোধ করে প্রিয়তমার নিকট তাঁর কুশল সংবাদ নিবেদন করতে, কাতর অনুরোধ জানায় তার বিরহিণী প্রেয়সীর কাছে বার্তা পৌঁছে দেবার। মেঘদূত কাব্য শেষ হয়েছে মঙ্গলাচরণ দিয়ে। মঙ্গল আচরিত হয়েছে মেঘের প্রতি যক্ষের আশিস বাণীতে: ‘ক্ষণকালের জন্যও যেন বিদ্যুত্ প্রিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদ না ঘটে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন: ‘উৎসবে যে মাটির প্রদীপের সুন্দর দীপমালা রচনা হয় পরদিন তাহা কেহ তুলিয়া রাখে না। ভারতবর্ষে আনন্দ-উৎসবে নিশ্চয়ই এমন অনেক মাটির প্রদীপ, অনেক ক্ষণিক সাহিত্য নিশীথে আপন কর্ম সমাপন করিয়া প্রত্যুষে বিস্মৃতিলোক লাভ করিয়াছে। কিন্তু প্রথম তৈজস প্রদীপ এখনো আমাদের ঘরে রহিয়া গেছে। আমাদের উজ্জয়িনীবাসী পিতামহের প্রসাদশিখরে তাহা প্রথম জ্বালিয়াছিল, এখনো তাহাতে কলঙ্ক পড়ে নাই।”
‘মেঘদূত’ স্বরবৈচিত্র্য, ধ্বনি গাম্ভীর্য, অতুলনীয় চিত্রকল্পের সমাবেশ এক অনন্য বর্ষাকাব্য। মন্দাক্রান্তা ছন্দে রচিত এর প্রত্যেকটি শ্লোক আপনাতে আপনি সমাপ্ত। প্রতিটি শ্লোক স্বতন্ত্র হীরকখণ্ডের মতো উজ্জ্বল এবং সমস্ত কাব্যটি হীরকহারের মতো সুন্দর। এই কাব্যে কালিদাস একই সঙ্গে প্রকৃতির কবি মানুষের কবি।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:“মেঘদূত ছাড়া নববর্ষের কাব্য অন্য কোনো সাহিত্যে কোথাও নাই। ইহাতে বর্ষার সমস্ত অন্তর্বেদনা নিত্যকালের ভাষায় লিখিত হইয়া গেছে। প্রকৃতির সাংবাৎসরিক মেঘোৎসবের অনির্বচনীয় কবিত্বগাথা মানবের ভাষায় বাধা পড়িয়াছে।”
শেষ করতে গিয়ে পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি গানের লাইন মনে পড়ছে,
“ওগো মেঘ তুমি উড়ে যাও কোন ঠিকানায়?
কে তোমায় নিয়ে যায়
দূর অজানায়,বলোনা আমায়]
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।