সাপ্তাহিক রম্য সাহিত্যে ইন্দ্রাণী ঘোষ (পর্ব – ১৯)

স্বয়ংসিদ্ধারা

কোন এককালে এক দিদি স্থানিয়াকে বলতে শুনেছিলাম ‘ধুর চাকরী বা ব্যাবসা করে কি হবে, ঘর সামলাও, বাইরে সামলাও । আমরা তো দুদিকেই ফেসেছি ।’ তখন সবে ইস্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজের প্রথম ধাপে আমরা । নিজের রোজগারের গন্ধটা সবে ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়ে ধাক্কা মারতে শুরু করেছে। আমরা তখন জানতাম বই, খাতা, পেন, ডায়েরী, রোল, ফুচকা, সিনেমার টিকিট এসবের মধ্যে নিজের রোজগারের গন্ধটা মিশে গেলে বেশ হয় । সেই দিদির কথাটা মনে ধরে নি । বরং তখন থেকেই এই চাকরী করা মেয়েদের একটা সুন্দর নাম দিয়েছিলাম ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ । আর এদের জন্য বরাবরই মনের মধ্যে একটি মখমলি আসন পেতে রেখেছি । অবরে সবরে তাদের সেখানে বসিয়ে একটু বাতাস করি । দুটো গপ্প করি তাদের সাথে ।

তা সে যাই হোক সময় গড়াল আমারও গতিবিধি বাড়ল । লোকাল ট্রেন এবং এক্সপ্রেস ট্রেন দুই চিনতে শিখলাম । এতে দুই ধরনের স্বয়ংসিদ্ধাদের চাক্ষুস করার সুযোগ হল । গণদেবতা, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে অধ্যাপিকা, শিক্ষিকার দল, অন্য স্বয়ংসিদ্ধাদের সাথে লোকালট্রেনগুলোতে মূলত দেখা হত । এই দ্বিতীয় দলের মানুষীরা বর্ধমান শহরের আশেপাশে চাকরী করতেন বোলপুর আর বর্ধমানের মাঝামাঝি স্টেশন থেকে উঠতেন । প্রথম দলের সকলে সারা হপ্তা বোলপুরে থেকে, মঙ্গলবার কলকাতা ফিরতেন, বুধবার বিশ্বভারতী বন্ধ থাকত । এই দুই দলের এবং পরবর্তী কালে অন্য স্বয়ংসিদ্ধাদের দেখেছি সকলেরই কয়েকটি বৈশিষ্ট এক, তা হল পারিপাট্য, ঢাউস ব্যাগের মালিকানা, অসম্ভব চটপটে স্বভাব, তড়িৎ গতির অধিকারিনী ।
তা এই ঢাউস ব্যাগগুলো একেকটা প্যান্ডোরাস বক্স । কি নেই সেখানে । বডি স্প্রে, লিপষ্টিক, ফেস ওয়াস, চিরুনি তো ছেড়েই দিলাম । আমার নিজের চোখে দেখা বর্ধমান থেকে উঠে বোলপুর পৌছনোর সময়টুকুর মধ্যে সে ব্যাগ থেকে বেরিয়ে পড়েছে গ্রেটার এবং বিশাল ফুটবল সাইজের বাঁধাকপি , গাজর, বীন, পেয়াজ, লঙ্কা । সে সমস্ত সবজি ওই লোকাল ট্রেনের কামড়ায় বসে গ্রেট করা হয়ে যাচ্ছে । বাড়ী ফিরে রান্নার প্রস্তুতি । তারমধ্যেই ছেলেমেয়ে ইস্কুল, কলেজ থেকে, কর্তা অফিস থেকে কোন ট্রেন ধরে ফিরবে, কটায় কোন ট্রেন ঢুকবে গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন । সে যুগ মুঠোফোনের নয়, কাজেই মনে মনে হিসেব কষে সকলের গতিবিধি অদ্ভুত পারদর্শিতায় মাপজোক করতেন তাঁরা । এই যেমন কর্তার অপিস ছুটি ছটায়, উনি ছটা পনেরোর ট্রেন ধরবেন বাড়ী ঢুকবেন সাড়ে সাতটায়, তার আগে গিন্নী ঘরে ফিরে চা, জলখাবার, রাতের রান্নার ব্যবস্থা শুরু করে ফেলবেন । বাড়ী ঢুকে হেঁসেলে ঢুকে পরার গপ্প করতে এরা দেখতাম বেজায় ভালবাসতেন । এদের শাড়ী, জামা কাপর, টানটান এবং রুচিসম্মত । কাঁথা বা বাটিকের সিল্ক হোক বা সুতি কেমন সুন্দর করে গুছিয়ে পড়েন । আলুথালু হবার কোন গল্প নেই । মনটা কানায় কানায় ভরে যেত এদের দেখে, আজও যায় । সবদিক কেমন সামলে নিচ্ছেন । মুখে কোন ক্লান্তির ছাপ নেই । ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, পরদিন রান্নার মেনু এইসব দিব্যি ছকে নিচ্ছেন চলার পথে ।
দু জন দিদিমণিকে চিনতাম, তখন আমিও চাকরী করি, তাঁরা ইস্কুলে পূর্ব বাংলার হেঁসেলের সমস্ত রান্না টিপিন কৌটো করে ভরে নিয়ে আসতেন । গোয়ালন্দ স্টিমার কারী, শুটকি বাটা, চিতল মাছের মুইঠ্যা, পিঠের দিনে সরু চাকলী, ইচার মূড়া, পাটিসাপ্টা, এ সমস্ত সহকর্মীদের খাইয়ে হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন । পুরুষ সহকর্মীরা ঠারে ঠোরে বলাবলি করতেন ‘অমুক দির তো হেঁসেলে পি. এইচ. ডি. । ক্লাসে গিয়ে কি চিংড়ি চরিত মানস, পেঁয়াজের পদাবলী, ময়দার মহাকাব্য পড়ান’ । এদিকে তাঁরাই কিন্তু সতৃষ্ণ নয়নে টিপিন কৌটোর দিকে তাকিয়ে থাকতেন । তা সে কথা যাক গে । ওরা ওসব বলেই থাকে ।
হালফিলের দক্ষীণ ভারতীয় মেয়েদের দেখেছি মাসে লাখ খানেক টাকা রোজগার করেও ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে পরিস্কার লিখে রেখেছেন কত টাকা বিবাহ পণ সে নিজেই দিতে পারবে । ভিতরটা কেমন গুমোট লেগেছে দেখে । এরা তবে কেমন আলোকপ্রাপ্তা বুঝি নি ।
মেঘে ঢাকা তারার নীতার জন্য বুকটা মুচড়ে উঠেছে যখন আরেক জন আধুনিকাকে বলতে শুনেছি ‘চাকরী করে জোয়াল টানতে পারব না, শুধু শপিং করব’ । আরেকজন সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছে ‘আমি বা আমার বর কেউ অটোমেটেড ট্রেলার মেশিন নই, দুজনেই রোজগার করি, খরচও আধা আধি ।’ চোখের সামনে সাম্যের জয়গান গেয়েছিল সেই কন্যে ।

আরও পরে চাকরী করা মেয়েদের টানাপোড়নও দেখেছি । দোর্দন্ডপ্রতাপশালিনী অধ্যক্ষাকে দেখেছি রাউন্ড দিতে দিতে নিজের মেয়ের জ্বরের খবর নিতে করিডোরে এককোনায় দাঁড়িয়ে । মুখমন্ডল কেমন শুকনো দেখাচ্ছে । এক দিদিমণি ক্লাশের শেষ পাঁচ মিনিট ঘড়ি দেখতেন, বিকেলের সূর্যের আলো তখন জানলা দিয়ে ক্লাশরুমে উঁকি দিচ্ছে । পরে জেনেছিলাম ওনার ছেলের ইস্কুল বাস আর ওনার বাস একসময় না পৌঁছলে ইস্কুলফেরত ছয় বছরের বাচ্চাটাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, সে তখনো এতটাই ছোট তাঁর জিম্মায় বাড়ীর চাবি দিতে ভরসা পেতেন না । বাড়ীতে মা আর শিশুপুত্র ছাড়া কেউ তখন ছিল না । সে ছেলে অবশ্য পরে দারুন স্বাবলম্বী হয়ে এখন জার্মানিতে দাপটের সঙ্গে পড়াচ্ছে । তবে সেই মা কাম দিদিমণিকে দেখে সেই বহুকাল আগের শোনা টানাপোড়নের কথাটি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম ।

তবে যে যাই বলুক গিয়ে এই সংসার, চাকরীর জাগলিং এর খেলায় মেয়েরা এগিয়ে পুরুষদের থেকে । তারা যে ভাবে দুদিক সামলেছেন এবং সামলাচ্ছেন আর কেউ পারবেই না এভাবে সামাল দিতে জীবনসাম্পানের হাল এবং বৈঠা । আর তাই এদের কথা বলতে বসেই মনে একটা বড়সড় রামধনু জেগে ওঠে নিজের অজান্তেই ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।