রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সকলে মিলে ডকুমেন্টরীর আনএডিটেড ভার্সন দেখা হচ্ছিল. কোথায় কোন মিউজিক দিলে ভালো, গ্রামবাসীদের ইন্টারভিউ কতটুকু রাখা হবে এ সমস্ত কেজো কথার সালতামামী. রাত্রে খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে যে যার ঘরে গেল. ঝোরা নিজের ঘরে ঢুকেই ঠং করে একটা আওয়াজ পেল, তারপরেই আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল. বিছানার পাশের জানলার বাইরে নিখাদ অন্ধকারে জ্বলছে দুটো ভাটার মত চোখ. ঝোরার চিৎকারে সকলে ছুটে আসে. ‘কি হল ঝোরা ম্যাডাম,?’ মেই লিং এসে ঝোরাকে বিছানায় বসান. ‘দুটো আগুনের মত চোখ, জানলার বাইরে, তার আগে একটা অদ্ভুত আওয়াজ পেলাম যেন’. অপূর্ব এগিয়ে আসে ‘ও কিছু না ম্যাডাম, ব্ল্যাক প্রিন্স বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, রাতে মনাষ্ট্রীর আর গেষ্ঠহাউসের বাগান পাহারা দেয় ব্ল্যাক প্রিন্স, ভয় পাবেন না’. খানিকটা আস্বস্ত হয়ে শুতে যায় ঝোরা. বাকীরাও যে যার ঘরে যায়. রাতে শুকনো পাতার উপর পায়ের আওয়াজ পায় ঝোরা, একটু পাখা ঝাপ্টানোর আওয়াজও আসে যেন. বাগানে লোহার পাত্রে জল রাখা দেখেছিল সে, হয়তো কোন রাতচরা পাখী জল খেতে এসেছে. সেই রাতটা ঝোরা জেগেই কাটিয়ে দেয়.
আসল ঘটনা ঘটল কয়েকদিন পর. শুট্যিং পর্বের একদম শেষেরদিকে এসে. ঝোরা, মেই লিং, মঞ্জরী সেদিন গ্রামের পথে হাটতে বেড়িয়েছে. আর দুদিন পর যে যার বাড়ী ফিরে যাবে. হাটতে হাটতে মঞ্জরী বলেন ‘এমন ছবির মত জায়গা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না,’ ‘তা তো বটেই, এমন অমলিন বাতাস আপনি পাবেন কোথায়?’ মেই লিং বলেন.
‘কটা দিন বেশ কেটে গেল আপনাদের সাথে. ফিরে গিয়ে আবার ছেলের কানাডা যাবার তোরজোড়, ছেলে কানাডা চলে গেলে আমি আবার বেড়িয়ে পড়ব. ছেলের কাছে কানাডা একবার ঘুরে আসার ইচ্ছে আছে, ছেলে সেটেল করে গেলে. এ দেশে আমাদের চাইনীস কমিউনিটির কেউ থাকতে চায় না, যাক যেখানে থাকতে চায় আমি মুক্ত বিহঙ্গ তারপর, শুধু ঘুরে বেড়াব. ঝোরা, আমি, আপনি বেড়াতে যেতেই পারি একসাথে. ঝোরার মেয়েও তো বড় হয়ে গেছে. ‘
ঝোরা খেয়াল করে মঞ্জরী অন্যমনস্ক হয়ে পরেছেন.’ একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলেন ‘আমার পিছুটান বলতে আমার কাজ, ইতিহাস আর ধর্ম খুজতে গিয়ে আমার আর সংসার করাই হল না.’
‘আপনি তো অন্বেষনে রত, এর চেয়ে বেশি সার্থক জীবন আর কি হতে পারে ড: বোস’.
‘না: তবু মনে হয় বড্ড যেন বাঁধনছেড়া হয়ে গেলাম’
ঝোরা আর মেই লিং দৃষ্টি বিনিময় করে.
‘আপনি ভাবার সময় পান ড: বোস?’
ঝোরা জিজ্ঞেস করে, দিগন্তে দৃষ্টি মেলে দিয়ে মঞ্জরী বলেন ‘মাঝেমাঝেই সময় ভাবিয়ে নেয় যে’.
কথা বলতে বলতে পাইনের জঙ্গলের রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা চলে এসেছে তিনজনে. কূলকূল শব্দ শুনে তিনজনেই দাঁড়িয়ে পড়ে. বয়ে চলেছে এক ঝর্ণা আর সেই ঝর্ণা গিয়ে মিশেছে এক গভীর নীল জলের হ্রদে, পাহাড়ের বেশ খানিকটা নীচে. পাহাড়ের গায়ে ফুটে রয়েছে অজস্র লাল অর্কিড, আর লাল নীল পাথর ছড়িয়ে আছে পাহাড়ী পথ জূড়ে হ্রদের কিনার অবধি. মেই লিং চঞ্চল কিশোরীর মত পাথর কুড়িয়ে ঝোলায় ভরতে থাকলেন. ঝোরা তাকিয়ে রইল সরোবরের জলের দিকে, আর ঝর্ণার পাশের পাথরের খঁাজ বেয়ে মঞ্জরী নামতে থাকেন, মেই লিং বলেন ‘আপনি নামুন আমরা আসছি’, রঙীন পাথর কুড়োতে আবার ব্যাস্ত হয়ে পড়েন তিনি. আর ঝোরা রঙের নেশায় বুঁদ হয়ে যেতে থাকে আস্তে আস্তে.
এমন সময় ঝপাং করে আওয়াজ, চমকে উঠে ঝোরা দেখে নীচে নীল সরোবর তোলপাড়, একজন মানুষ মনে হচ্ছে ঝাঁপ দিয়েছে জলে. আর আরেকজন প্রাণপণ সাঁতার কেটে ঠিক মাঝ সরোবরে পৌছতে চাইছে. ঘটনার আকস্মিকতায় ঝোরা ও মেই লিং বাক্যিহারা হয়ে যায়. ঝোরা কোনমতে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখে মঞ্জরী ডুবে যাচ্ছেন মাঝ সরোবরে. অপূর্ব প্রচন্ড ক্ষিপ্র গতিতে সাঁতার কেটে মঞ্জরীর কাছে পৌঁূছতে চেষ্টা করছে, অপূর্বর পাশেপাশে সাঁতার কাটছে ব্ল্যাক প্রিন্স.