“নীল সুনীলে দিন যাপন” গল্পে স্বাতীর আলোয় হেমন্ত সরখেল

যোদ্ধা

ইন্টারকমটা আওয়াজ করতেই চটক ভাঙে সেলিমে’র |
‘— একটু আসবেন? — হ্যাঁ, আসছি ‘ | বসের ডাকে সাড়া দিতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চেয়ারটা ছাড়তে হয় তাকে |
আজ সকাল থেকেই একটা অন্যমনস্কতা ঘিরে রয়েছে | আটতলা’র কাঁচে ঘেরা অফিস কেবিনের জানলা দিয়ে ক্ষয়িষ্ণু সূর্যের গলন্ত সোনার ঝিলিকও অন্য দিনের মতো আজ টানছে না | এটাই তার কাছে সব থেকে প্রিয় বস্তু, বিকেলের সূর্যাস্ত, নিজের কেবিনে বসে দেখা | সেটাও যেন আজ খোল নলচে বদলে ফেলেছে |
—-আশ্চর্য্য! কেন এমন হচ্ছে? নিজেকেই ছুঁড়ে দিল প্রশ্নটা |
‘ আজ অফিস থেকে ফেরবার সময় ফুলওয়ালা বিশুকে বলে দিস্ তো, কাল সকালে একটা তোড়া বানিয়ে দিয়ে যাবে..’
বৃদ্ধ বাবা’র দিকে অবাক হয়ে তাকালো সেলিম-
‘ কেন ? হঠাৎ ফুল কি হবে ?’
‘ কালকে’র তারিখটা ভুলে গেলি? কাল একুশে ফেব্রুয়ারী!’
‘ তো! আমার এখন অনেক চাপ | ২১ -২২ ভাবতে পারছি না, মনে থাকলে বলে দেব’ — খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে ওয়াশ বেসিনের দিকে এগোয় সে…..
‘ অমর!’ — শব্দটা ফেটে পড়ে বাবা’র গলা থেকে | অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় সে | আজ বহুবছর পর এই নামটায় বাবা তাকে ডাকলেন,
‘ তোমার থেকে অন্ততঃ এটা আশা করিনি |’- গলাটা ধীর, অসম্ভব গম্ভীর | যেন কোনো দিগন্ত থেকে ভেসে আসা সুদূর পরাহত ধ্বনি | মা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো | বাবার শরীরটা মৃদু তালে কাঁপছে | পঁচাশি ছুঁই ছুঁই আসগার আলী এখনও যথেষ্ট ঋজু,সুঠাম ব্যক্তিত্বের অধিকারী |
‘ আমি আসগার | আসগার আলী | নিজের চোখের সামনে দেখেছি, কীভাবে প্রাণের কথা প্রকাশের দাবিতে তোমার থেকেও অনেক বেশি প্রতিশ্রুতীবান ছেলেরা অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিল– আহমেদ, জব্বার, বরকত, সালাম, শফিউর – নামগুলো তো তোমার ছোট্টবেলা থেকেই শোনা-তাই না?’ – প্রশ্নের সাথে একটা শ্লেষ যেন ছিটকে এ’ল !
কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে আটকালো সে | সাধারণতঃ চুপচাপ থাকা মানুষটা আজ কিছু বলছে- বলছে বিশেষ কিছু | নয়তো- এতো অশান্ত কেন?
কাহিনিগুলো মোটামুটি জানা তার দাদীর কাছ থেকে | পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, ১৯৫২-র ২০ শে ফেব্রুয়ারীর ১৪৪ ধারা | মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার সম-মর্যাদায় দেখার দাবিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সরকারী দমন নীতির বিরুদ্ধে এক প্রাণখোলা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন | ধর্মঘট-হরতাল-সমাবেশ-মিছিল- নিরীহ মানুষকে হত্যা-অবশেষে ১৯৫৬ সনের ২৯শে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষাকে সেই সরকারের স্বীকৃতি দান– দাদী এমন ভাবে বলতো, যেন চোখের সামনে দেখছে- মহাভারতের সঞ্জয়!
‘ আজ তোমার কাছে নিজের ভাষার জন্য সামান্যতম সময় নেই ? তাহলে ওরা কি নির্বোধ ছিল ? আজকের দিনটা আর আগামীকালের তারিখটা- ২০ আর ২১, পুলিশের রক্তচক্ষু- বেয়নেট, বুলেট, রক্তে ভেজা ইতিহাস লিখেছিল ৫২ তে | যাতে-যাতে- তুমি, তোমার মা কে ‘মা’ বলতে পারো-সারাজীবন–আমৃত্যু…’
‘ শান্ত হও, শান্ত হও- বসো, চেয়ারটাতে বসো ‘ – পেছন থেকে ধরে মা ওনাকে বসিয়ে দেন চেয়ারে |
‘ জলটা খাও |’
চুপচাপ হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে সেলিম | কী আছে ঐ কথাগুলোর মধ্যে ? কেন চোখে চোখ মেলাতে পারছে না ?বেড়িয়ে যেতে যেতে ‘আমি আসি’ বলার সময় এক লহমায় দেখ’ল তখনও জল ভরা কাঁচের গ্লাসটা সামনে রাখা, উনি প্রখর দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রয়েছেন | যেন পালিয়ে বাঁচল আজ!
আনমনেই কখন যেন ফেসবুকটা ক্লিক করে খুলে ফেলেছে।বাংলাদেশের সরকারী সাহিত্য পরিষদের সাইটটা ক্লিক করতেই একটার পর একটা পোষ্ট- বাংলা ভাষাকে নিয়ে | মন্দ নয়! দু-তিনটে পড়েও ফেলল! —আচ্ছা! এই যে পড়ছি, চিন্তা করছি– এটাও তো সেই বাংলাতেই–সত্যিই যদি ‘৫২ তে ওরা প্রতিবাদের ঝড়টা না তুলতো, তবে কী হতো ? মাথাটা যেন অসার হয়ে এল | সত্যিই তো! এটা তো ভেবে দেখা হয়নি! ভাবতে ভাবতে কখন জানি একটা অদ্ভুত ভালো লাগা ছড়াতে থাকে মাথায়-প্রাণে-সমস্ত শরীরে- সত্ত্বায় আত্মস্ত হয়ে যায় সেই বোধ…
ভোরবেলাতেই ঘুমটা ভাঙে অ্যালার্মে | চুপচাপ বেড়িয়ে সটান বিশু’র বাড়ি | কাল বলেনি, সকালেই তাজা ফুলের তোড়াটা তার চাই | বললে হয়তো বাসি ফুল দিয়ে বানিয়েই ফ্রিজে রেখে দিত বিশু |
ফেরার পথে কাশীদা’র চায়ের দোকানে এক কাপ চায়ের ফরমাইশ কর’ল | কাশীদা হাতের তোড়াটা দেখে বল’ল,
‘ আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারী- তাই না অমর ?’
‘ ত্ -তুমি? তুমি আমার এ নাম জানলে কী করে? আর ২১ শে ফেব্রুয়ারীটা ? ইন্ডিয়াতে?’
‘ তুমি অনেক ছোট ছিলে | তোমার বাবা আসগার আলী নিজেই একজন ভাষা আন্দোলনের কর্মঠ যোদ্ধা | অনেকে হারিয়ে গেছেন, তাদের সাথে উনিও হারিয়েছেন সকলের বিস্মৃতিতে | নাও, চা খাও | অমর একুশের নামেই আসগার’দা তোমায় অমর বলে ডাকেন…’
বাড়ি অব্দি আসতে আসতে মনে হ’ল তার আকাশটা আজ হঠাৎ, অনেক বড়ো হয়ে গেছে | দরজায় আাকাশের দিকে মুখ তুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আনমনা অনমনীয় যোদ্ধা | চোখে চোখ পড়তেই হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তোড়াটার জন্য- চোখে আনন্দের বন্যা নিয়ে- চুপচাপ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।