ধলেশ্বরীর অন্য ধারায় ভ্রমন কাহিনীতে লোকমান হোসেন পোলা

কান্তজীর মন্দির বিচিত্র কারুকায ও মূর্তিখচিত কালের সাক্ষী

“সুনীলের কেউ কথা রাখেনি কবিতা সেই কান্তজীর মন্দির” বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর মন্দির । শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তির অসাধারণ এক নিদর্শন এই মন্দির। দিনাজ পুরের টেপা নদীর ওপারে কান্তনগর গ্রামে এর অবস্থান। এই মন্দিরেরর নির্মাতা হিসেবে সাধারণ মানুষ রাজা রামনাথকে জানলেও প্রকৃতপক্ষে মন্দিরের সূচনাকারী ছিলেন প্রাচীন দিনাজপুরের জমিদার রামনাথের বাবা মহারাজ প্রাণনাথ রায়। মৃত্যুজনিত কারণে প্রাণনাথ নির্মাণ কাজ শেষ করে যেতে পারেননি, মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে রাজা রামনাথ নির্মাণকার্য সমাধা করেন; কাজ শেষ হয় ১৭৫২ সালে।
কথিত আছে, মন্দিরটি নির্মাণ করতে প্রায় ২০০ বছর সময় লেগেছিলো। দিনাজপুর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে ঝলমলে এ মন্দিরে যিনিই একবার গিয়েছেন তিনিই বাঁধা পড়ে গেছেন এর অনন্য সৌন্দর্যজালে! শান্ত, নির্জন, নিরিবিলি পরিবেশে নির্মিত এ মন্দিরের দরজাগুলো কাঠের। দেখতে অনেকটা রথের মতো, ইট ও পাথরের কণা দিয়ে নির্মিত কান্তজীর মন্দিরের দেয়ালে খোদাই করা আছে ছোট ছোট ভাস্কর্যের প্রতিচ্ছবি- দেয়ালে নৃত্যরতা রমনী, গায়ক, দেবতা, শিকারি, দেবতা, নৌকার মাঝি, নারী, পুরুষ, কিন্নর, যোদ্ধা, গায়ক, গৃহিণী, পালকি বাহকসহ আরো অনেক কিছু।
বিচিত্র মূর্তিখচিত এ দেয়ালে রয়েছে রামায়ণ মহাভারতের অনেক কাহিনী। শ্রীকৃষ্ণ এবং পৌরাণিক কাহিনী তো আছেই। প্রতি বছর রাসপূর্ণিমার রাতে উদযাপিত হয় রাসলীলা । জানা যায়, ৫২ বর্গফুটের এই মন্দিরের উচ্চতা ৭০ ফুট। মাঝখানে অবস্থিত মন্দিরের আয়তন ২৭০৪ বর্গফুট। মন্দিরের দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে রয়েছে নয়াবাদ মসজিদ। ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত মসজিদটির শিল্পচাতুর্য এবং অনুপম নির্মান খুব সহজেই মানুষের মন কেড়ে নেয়।
মন্ধির ঘুরে ফেরার পথে চেহেল গাজীর মাজার। এ মাজারে রয়েছে ৪০ জন বীরযোদ্ধার সমাধিসৌধ। মাজারের কাছে ঐতিহাসিক ছোট একটি মসজিদ। পশ্চিমদিকে অবস্থিত মসজিদটির সিংহভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে। ধারণা করা হয় এটি নির্মিত হয়েছিলো ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে। মাজারের ২০০ গজ উত্তরে এক একর আয়তন বিশিষ্ট একটি ঢিবি রয়েছে। এই ঢিবিতে প্রচুর ইট পাওয়া যায়। সম্ভবত এটি হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের কোনো মন্দিরের ভগ্নাংশ।
দিনাজপুরের যে দুটি কীর্তির জন্য রাজা রামনাথ অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন তার একটি কান্তজীর মন্দির অন্যটি রামসাগর। রাজার নামেই নামকরণ হয়েছে রামসাগরের। তবে নামে সাগর হলেও এটি সাগর বা মহাসাগর নয়-এটি আসলে একটি দীঘি। দীঘির আয়তন ১৬২৮১২০ বর্গফুট বা ৫৪২৭০৭ বর্গগজ। শান্ত ও সুগভীর এ দীঘির অবস্থান দিনাজপুরের তাজপুর গ্রামে। উত্তরদক্ষিণে লম্বা দীঘিটি খনন করা হয় ১৭৫০ থেকে ১৭৫৫ সময়কালে।
কথিত আছে, রাজা রামনাথের আমলে বৃষ্টিপাতের অভাবে একবার ক্ষেতের সব শষ্য নষ্ট হয়ে যায়। প্রকৃতি হয়ে ওঠে রুক্ষ ও ধূসর। অনাবৃষ্টির অভিশাপে জর্জরিত হয় সাধারণ প্রজা। প্রজাদের দুঃখদৈন্য মেটাতে মহাপ্রাণ রাজা খনন করান দীঘিটি। তারপর থেকে বহুকাল পর্যন্ত এটি রয়ে গেছে। রামসাগারকে ঘিরে যে সৌন্দর্যের পশরা বসেছে তা বর্ণনাতীত। ফল-ফুল-বৃক্ষশোভিত বনপ্রান্তর মনকে হারিয়ে দিতে চায়। এ দীঘির উত্তরপাড়ের বহিরাংশে রয়েছে একটি মন্দির, মন্দিরটি এখন জীর্ণশীর্ণ ও ভগ্নপ্রায়। অতীতে এটি ছিলো দেবমন্দির। জানা যায়, এদেব মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিলো দীঘি খননের পরপরই। দীঘিটি বহালতবিয়তে থাকলেও ধ্বংস হচ্ছে মন্দিরটি।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে হানিফ শ্যামলী, নাবিল, কেয়া পরিবহনের বিভিন্ন বাস সকাল-সন্ধ্যা দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে। বাসে সময় কম লাগে। কিন্তু আরাম করে যেতে চাইলে ট্রেনে চেপে দিনাজপুর যাওয়া সব চেয়ে ভালো। সময় লাগবে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার মতো। সকালে একতা এক্সপ্রেস আর রাতে দ্রুতযান এক্সপ্রেস কমলাপুর থেকে দিনাজপুর ছেঁড়ে যায় প্রতিদিন। বাসের টিকেট সহজ হলেও ট্রেনের টিকিট আগেই কেটে রাখতে হবে, সঙ্গে ফিরতি টিকিট।
কোথায় থাকবেন
দিনাজপুর শহরের উত্তরে কান্তনগরে অবসি’ত কান্তজীর মন্দির। কান্তজীর মন্দির যেতে হলে আপনাকে শহরের দশমাইলের ওপর দিয়ে যেতে হবে। দিনাজপুর শহর থেকে কান্তজীর মন্দিরের দুরত্ব ১০ থেকে ১২ মাইলের মতো। দিনাজপুর শহরে রাত যাপনের জন্য ভালো হোটেল আছে। হোটেল দিনার, হোটেল আল-রশিদ এসব হোটেলের মধ্যে অন্যতম। তাছাড়া আপনি চাইলে হাউজিং মোড়ে অবসি’ত পর্যটন মোটেলে রাত্রি যাপন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আপনাকে আগে থেকেই বুকিং দিয়ে যেতে হবে। খাবারের জন্য হোটেল মুন্সি ও নিউ হোটেলের ওপর ভরসা করা যেতেই পার।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।