আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। তারপরেই বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত হবে মহালয়ার সুরে। আমাদের রক্তের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া এই সুর কানে না আসা পর্যন্ত শারদ উৎসব পূর্ণতা পায় না। মনে পড়ে যায় অনেক বছর আগের কিছু স্মরণীয় ভোর। তখন আমি ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ি। টিভি তো দূরের কথা। গোটা পাড়া খুঁজে ফেললে খুব বেশি হলে গোটা তিনেক মাত্র রেডিও। তার মধ্যে একটি আমাদের বাড়ির পাশেই আমার বড় জ্যাঠামশাই-এর। এটাই তখন আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। আমি সারারাত ঘুমােতাম না। আসলে এত আনন্দ হতো যে দু’চোখের পাতা এক করতে পারতাম না। হ্যাঁ, আনন্দ হতো। সকালে শরতের নীল আকাশে সোনা রোদ দেখার আনন্দ।
মা ডেকে দিত —– “উঠে পড় মহালয়া শুরু হয়ে গেছে” —- আজও কান পাতলেই মায়ের সেই ডাক শুনতে পাই। মা জানতই না আমি সারারাত জেগে। দরজা খুলতেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠস্বর। জ্যাঠামশাইরা দুয়ারে রেডিও বার করে দিয়েছে। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে মাটির দুয়ারে শরতের নতুন ঠাণ্ডায় এসে বসতাম। বাবা সঙ্গে সঙ্গে সুতির শুকতারা চাদরে মাথা ঢেকে দিয়ে গলার কাছে বেঁধে দিত। সে এমন বাঁধা যে হাত পা নড়াচড়া করতে পারা যেত না। একেবারে জড়ভরতের মতো বসে থাকতে হতো। যে মানুষটা ঠাণ্ডায় বাইরে বের হলে বকে তার আজ কি উৎসাহ আমি মহালয়া শুনি। সারারাতের জাগরণের ফল —— শুনতে শুনতে চোখ জুড়ে আসত। তবুও যতটুকু কানে আসত মনে হতো দু’কান দিয়ে যেন আনন্দ এসে ঢুকছে। দেখতাম অন্ধকার আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছে। সকাল হলেই মনে হতো দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গেছে। যদিও দুর্গাপুজোর সঙ্গে কোনোকালেই আমার কোনো গভীর সম্পর্ক ছিল না। শিউলি কাশ যেমন শরতের এক একটা অংশ, ঠিক তেমনই দুর্গাকেও আমার একটা অংশ বলে মনে হতো। আজও এই ভাবনার বিন্দুমাত্র কোনো পরিবর্তন হয় নি।
আজও মহালয়া হয়। কানে আসে। আর মনে পড়ে যায় সেই ছোটবেলার কথা। দেখতে পাই আমার পাশে বসে আছে বাবা আর মা। আমি তাদের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে মহালয়া শুনছি। বুঝতেই পারি না, দুটো চোখ কখন জলে ভিজে গেছে।