আজ আপনাদের এক মায়ের গল্প বলব। প্রতিদিনের মতো তালাণ্ডু স্টেশনে বসে আছি। আপ প্লাটফর্মের একেবারে প্রথম দিকে। সিমেন্টের চেয়ারে। বাইরে রোদের তেজ বেশ ভালোই। চোখের সামনে একটা বই খোলা। দেখলাম এক বুড়ি ( প্রায় হাঁটুতে মুখেতে হয়ে গেছে ) লাঠি ধরে ধরে এক পা এক পা করে আমার পাশে এসে বসলো। তাকিয়ে দেখলাম কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছছে আর মুখে বলছে, “এই রাস্তাটা দিয়ে যাওয়া যায় কিনা কে জানে।” বুড়ি যে রাস্তাটার কথা বলছে সেটা হাঁটা পথে রেললাইন পার হয়ে মাটির রাস্তায় নেমে গেছে। এমন ভাবে কথাটা বলছে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে যেন আমি এর উত্তর দিই। কেন জানি না আমি আগেও দেখেছি স্টেশনে বসে থাকলে আমাকে সচারাচর কেউ কোনো কথা জিজ্ঞাসা করে না। হয়ত আমি এমন মুখ করে বসে থাকি যেটা কোনো মানুষের মুখের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়ত আমার গায়ের রঙ, টাক মাথা কথা বলার জন্যে উপযুক্ত নয়। সে যাই হোক আমি নিজে থেকেই কথা বলে উঠলাম —– “হ্যাঁ বুড়িমা, যাওয়া যায়। আমি গেছি। তবে তোমাকে একটু আস্তে আস্তে যেতে হবে।” আমাকে কথা বলতে দেখে বুড়ি একটু নড়েচড়ে বসল। আচরণ দেখে মনে হলো খুব খুশি। এবার বলে চললো তার কথা। বুড়ির দুই ছেলে এক মেয়ে। ছোট ছেলে বুড়িকে ভাত দেয় না। তাই বুড়ি বড় ছেলের কাছে থাকে। বড় ছেলে আর তার বউ কথায় কথায় বুড়িকে অপমান করে। কোনো কোনো সময় মারে। এখন বুড়ি যাচ্ছে মেয়ের কাছে। কারণ জানতে চাইলে বুড়ি জানাল, আজ দুপুরেই খুব ঝগড়া হয়েছে। বুড়ি ভাত না খেয়ে কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়েছে। আমি বললাম, ভালোই তো, বেরিয়ে যখন পড়েছ তখন মেয়ের বাড়িতে গিয়ে কয়েক দিন থাকো। বুড়ি চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ইচ্ছা তো করে বাবা, কিন্তু পারি না। একদিন থাকার পরই ছেলেটার জন্যে মনখারাপ করে। মনে হয় নাতিটাকে কতদিন দেখিনি।
নিজের মাকে দেখেছি। আর এক মাকে চোখের সামনে দেখছি। খুব জানতে ইচ্ছে করে, এইসব মানুষগুলো কি দিয়ে তৈরি। কত চোখের জল থাকে এদের ? ছেলের হাতে মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসে আবার সেই ছেলের জন্যেই চোখের জল ফেলে ! কতদিন আর এইসমস্ত মানুষেরা বেঁচে থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে? আর কতদিন সুযোগ পাবো আমরা ? সত্যিই কি আমরা আর কোনোদিনই মানুষ হব না ?