গ এ গদ্যে গৌরব অধিকারী

বিবাদী

সকাল থেকেই ঝমঝম বৃষ্টি… অফিস আসার সময়ে ফেয়ারলী পেরিয়ে সনাতন দার দোকানের সামনেই হাওয়াই চটি সাইজের( অন্য মানে খুঁজবেন না প্লিজ😊) বেগুনি ভাজা হচ্ছে.. নীল বস্তায় মুড়ি.. বেগুনি এট্টু বিননুন আর একপিস কচি কলঙ্কিনী লঙ্কা… উফ..!!
বিবাদী বাগ স্টেশনের সামনে দিয়ে পেরোনোর সময়ই সার সার দোকান.. রাস্তার ঐ ফুটে গেলেই একের পর এক খাদ্য মেলা.. সামনেই দাঁড়িয়ে কাস্টমস হাউস, ইস্টার্ন রেলওয়ে.. ভরা বর্ষা তেও প্যান্ট গুটিয়ে হাতের প্যাকেট খুলে সবেদা, জেলি পাউরুটি খেতে খেতে টিকিট এর লাইনে দাঁড়িয়ে সার সার মাথা..
ছাতার দোকানে ভিড়ে ভিড়.. লাল ফুটকি ফুটকি ছাতা থেকে কমল মিত্রের মত গম্ভীর বিরাট সাইজের ছাতার মেলা.. দর দাম করে মাথা বাঁচানোর লড়াই..
ডালহৌসি অফিসপাড়া একমাত্র এলাকা যেখানে সবচে সস্তায় ভালো খাবারের সেরা ঠিকানা.. সে বেগুনের তরকারি দিয়ে রুটি জিলিপি হোক বা ছাতুর রুটি সঙ্গে আচার.. মিক্স চাউমিন থেকে মাত্র ২০ টাকায় নারকেল, কাজু, কিসমিস, একটু আলু সেদ্ধ, একপিস লঙ্কা ভাজা বা পাঁপড়, এক চামচ চান্নি আর ঝুরি ভাজা.. সব মেলে সব.. প্লেট আর পকেট বুঝে বিনোদন..
খাওয়া দাওয়া র পালা মিটলে গুটি গুটি পায়ে রাইটার্স এর দিকে হাঁটা.. সামনের ফুটে বিস্তর কাদা.. গোড়ালি সামলে পদব্রজে এগিয়ে চলা.. কাদায় পড়লে সবাই মাইকেল জ্যাকসন..
রাইটার্স এর সামনে একটা ছোট খাট হ্গ মার্কেট যেন.. লস্যি, বেলের পানা থেকে নান রুটি, সর্ষে দিয়ে শাক, মটর পনির থেকে কাঁচা আম থেঁতো করে কাসুন্দি বিট নুন লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে একেবারে বীভৎস ব্যাপার মশাই… এতেও মন না ভরলে সাদা গান্ধী টুপি পরা ধুতি আর বাংলা শার্টের ভুজিয়া ওয়ালারা আছেন.. চানাচুর, পাপড়ি, লেবুর রস নুন মরিচ দিয়ে ঠোঙ্গার ভেতর ঝমঝম করে ঝাঁকিয়ে দিলেই ব্যাস… জিভে দিলে গলে যাবে.
সামনেই সস্তার বিরিয়ানী.. জামাই দা , কার্তিক দার সঙ্গে টুক করে আলাপ সেরে নিলে পরের বার আর ফাউ চাইতে হবে না.. প্লেটের চাল কমতির দিকে দেখলেই
” একটু দেখি স্যার..” বলে প্লেটে খানিক চাল, আলু আর মেটে সমেত ঝোল…চাল এখানে শোধ করতে হয় না.. পেটে চলে যায় জন্মের মত..
এছাড়া ধোসা, ইডলি, পাউরুটি আলুরদম, মোগলাই চা ফিস ফ্রাই মোমো ঝল মুড়ি, একশো রকমের মিষ্টি নান খাটাই, চিঁড়ে কি নেই..
সোজা এগোলেই রাইটার্স এর সামনে আর একটু বেলায় আরবিআই এর বাঁ দিকে সরকারি গাড়ি এসে দাঁড়ায় একটা.. পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমবায় সমিতির গাড়ি.. বাংলার নানা গ্রাম গ্রামান্তর এর মা বোনেরা যত্ন করে স্বামী সংসার শাশুড়ী পুজো উপোস সামলে বছর ভর তৈরি করেন মশলা বড়ি, গয়না বড়ি, আচার, মিছরি, মধু, বাদাম তক্তি, ক্ষীরের বাতাসা সব কিছু.. তবে মেন ক্রেজ টা হল মাত্র আট টাকায় খেজুর( নাকি তাল মনে নেই) রসের তৈরি ঠান্ডা কোল্ড ড্রিংকস… এরকম কোল্ড ড্রিংকস ভূ ভারতে আর কোথাও পাওয়া যায় বলে জানা নেই আমার…
রাইটার্স এর সামনের ফুটেই দোকান করতেন খোকন দা.. ভগবতী বিস্কুট কোম্পানির এই প্রাক্তন কর্মী কারখানা বন্ধ হবার পর কি করে পেটের ভাত জোগাড় করবেন ঠাওর করতে না পেরে প্লাস্টিক পেতে বই বিক্রি করতেন.. শুরু করেছিলেন 22 পিস বই দিয়ে.. এখন তার পুরো পরিবার বই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন…
বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি দুষ্প্রাপ্য সব বই মারাত্মক কম দামে ছেড়ে দিতেন.. প্রয়াত হয়েছেন মাস খানেক হল.. দোকান বন্ধ থাকেনি.. লেটেস্ট ম্যাগাজিন থেকে পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বন ও মেলা, চাঁদ মামা, বাঁটুল দি গ্রেট থেকে দেখি নাই ফিরে বাংলায় ভ্রমণ বরাত ভালো থাকলে মিলে যাবে..
কলকাতা ও গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যে কত বিচিত্র বিষয়ের সংগ্রাহক আছেন এই দোকানে এসে মালুম হয়েছে আমার.. কেউ জমান জলছবি তো কেউ জমান সত্যজিৎ রায়ের, উত্তম কুমারের পোস্টকার্ড সাইজ ছবি, কেউ জমান ইন্দ্রজাল কমিকস তো কেউ জমান পুরশ্রী পত্রিকা, কারো কাছে স্ট্যাম্প এর বিশাল সংগ্রহ তো কেউ জমান বিজ্ঞাপন এর কাগজ.. রকমারি মানুষ রকমারি চাহিদা..
বই ঘেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়লে উল্টোদিকে মোহনের চা আর তার সঙ্গে এই 18 পার্সেন্ট জিএসটি র বাজারেও ৬ পিস লুচি দুরকম সবজি ডাল সমেত ১০ টাকা… খাবার পরে কর্পূর মেশানো জগের জল খেলে মনে হবে কলকাতা বড্ড সুন্দর..
সামনে এগিয়ে গেলেই ডাব, দই বড়ার দোকান পেরিয়ে বেনটিনক স্ট্রীট.. সেখানে আবার বিচিত্র খাবার দোকানের গল্প হবে আরেকদিন…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।