সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে গোবিন্দ ব্যানার্জী (পর্ব – ৩)

পাহাড়ী গ্রাম সূর্যোন্ডি

টুটুন হাত দু’টো বুকের কাছে জড়ো ক’রে বলছে… এই অধমের নাম টুটুন দত্ত। সার্টিফিকেটের বেড়ার ভিতরে জ্বলজ্বল করছে দীপ্তেন্দু। যদিও ওটা বাক্সে তোলা থাকে, খুব তেমন ডাক না পড়লে ঢাকনা তুলি না। ঐ চাপা প’ড়ে থাকতে থাকতে আমার মতই বুড়ো হ’য়ে গেছে। হত কুচ্ছিৎ এই তোবড়ানো মুখের সাথে তার কোন মিলও নেই এখন। যাকগে, ওসব। সেই যৌবনে অংক করাতাম ছাত্রদের… তারপর সে বেসাতিও ছেড়েছি। এবং বেঁচেছি। এমুড়ো ওমুড়ো ঘুরে বেড়াই। ঐ পাহাড়ের কাছে… মুখ্যু সুখ্যু তো, তাই মৌন নিস্তব্ধতার কাছে যাই, কৃতাঞ্জলিপুটে নতজানু ব’সি… যদি কিছু শিখে উঠতে পারি। এ জীবনে তো আর শহুরে জোচ্চুরি শিখে উঠতে পারলাম না, এদিকে পা দু’টো বাড়িয়ে দিয়েছি দাগের ওপারে। ঐ ধুলো লাগছে। লাগুক। তাতেই সেজে উঠি মাঝেমধ্যে। আকাঙ্খা আর গার্গী অবাক হ’য়ে শুনছে। গার্গীর মেয়েটা মায়ের বাঁ বাহু চেপে ব’সে আছে। আর গার্গীর পায়ের কাছে জড়ো হ’য়ে আছে গোটা ছ’য়েক পলিথিনের প্যাকেট।

এখন সময় একটু গুছিয়ে বসার। টুটুন প্যাকেটগুলো উপরের বাঙ্কে তুলে দিচ্ছে। উল্টো দিকের জানলা আগলে ব’সে আছেন এক অবাঙালী যুবক। আর
এপাশের জানলায় বয়স্ক মহিলা। তাদের সাথে আলাপ হ’তে দেরী হ’লনা। এমন কি ফোন নম্বর পর্যন্ত নেয়া হ’য়ে গেল টুটুনের। এবং চলতি ট্রেনে আমাদের সিট অনবরত সাফলিং হ’য়ে চলেছে। আকাঙ্খার বড় ট্রলি ব্যাগটা নীচেই রাখতে হ’ল। আর ঢাউস ন্যাপস্যাকটা উপরের বাঙ্কে। টুটুন কথা না বললেও,  মন অবাক হ’য়ে দেখছে সে ব্যাগের সাইজ… যে ওকে বলতেই হ’ল… আমার সাত আট দিনের ট্যুর। পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডিতে, অযোধ্যা পাহাড়ে আর বোলপুরে গানের প্রোগ্রাম আছে… তাই বেশ ক’য়েক সেট পোশাক নিতেই হয়েছে। কি করবো। গার্গী কোলে রাখা ছোট ব্যাগ থেকে চিপস্ এর প্যাকেট বের ক’রে  মেয়ের হাতে দিচ্ছে। আর পাশের কম্পার্টমেন্টে চা… লিকার চা… ধ্বনিত হবার সময় ট্রেন বাগনান স্টেশনের দীর্ঘ প্লাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে। টুটুন দাঁড়িয়ে পড়ল। এই… উচ্চারিত হবার কথা চা…, কিন্তু বলছে… সবার চা চলবে তো…? তিনটি হ্যাঁ ধ্বনি একটা অদ্ভুত সুর তরঙ্গে বেজে উঠল। যার একটাই মানে… তৃষ্ণার্ত।

এই সময় চায়ের কাগুজে কাপে ঠোঁট চেপে রেখে একটু মগ্ন হ’তে ইচ্ছে করে। ভাবছি… যদিও সে সব ছড়ানো ছিটানো। তাওও। আকাঙ্খার গান। পুরুলিয়ার বরাবাজার বইমেলা। আহা প্রভাতফেরী। উদ্বোধনের সকালে সেই নগর পরিক্রমণ দলে আমরাও যোগ দিলাম। সেখানেই প্রথম শুনলাম ওর গাধ। ও হোঃ… এত উদাত্ত লোকস্বর… ভাব হ’তে আর দেরী হয় নি। তারপর সেই পদযাত্রায় কত ক ত্ত গান… মনে পড়ে যাচ্ছে টুটুনের বার তিনেক  ফেসবুকে ব্লক ক’রে দেয়া আমাকে। আর প্রতিবারই শহুরে সজ্জিত আমিটাকে বেদম খিস্তি মেরে। ঐ খানেই মাত দিয়েছি ওকে। যে খোলাখুলি খিস্তি দিতে পারে, তাকে বুঝে উঠতে আর সময় লাগে না। জোর ক’রে আদায় ক’রে নিয়েছি ওর গোটাকতক কবিতা, এমন কি ব্যক্তিগত কথোপকথনও… আমার  ত্রিকার জন্যে। ঐ আর কি, যা হয়… তারই মধ্যে প’ড়ে নিয়েছি চারণিকের পাহাড়ীকথা। বদন বইয়ের খানিক খানিক। সপাট লেখা। অন্যরকম। কিন্তু  সাবলীল উৎসারিত। ঠিক ওর নিপাট আঢাকা খিস্তির মত। তবুও ত বু ও… সাত আট দিনের ঝাড়গ্রাম সফর সেরে ফেরার পথে ও চ’লে এসেছিল সোজা কোলকাতা বইমেলায়, সেই তো প্রথম দেখা… ট্রেন ঝাড়গ্রাম স্টেশনে ঢুকছে। আকাঙ্খা মোবাইলেট্রেনের তাৎক্ষণিক চলমানতা দেখে একটু আগেই তা
জানিয়ে দিয়েছে। অতএব উঠতে হ’ল, গেটের কাছে যাওয়া দরকার। এখান থেকে পোশাক ঠাসা খান তিনেক বস্তা নিয়ে কালিপদ আর মণিশঙ্কর উঠবে।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।