প্রায় চার বছর পর দেবাশিস দুর্গাপূজার সময় দেশের বাড়িতে এলো। ডক্টরেট করতে বিদেশ যাওয়ার পর প্রথম ফেরা। অনেকদিন বাড়িছাড়া, বাড়ির লোকের জন্য মন কেমন করছিল, শরতের মেঘের মতো মন ভাসতে ভাসতে বাড়ির পথে পাড়ি দিতে চাইছিল। পথের পাশে ঝরা শিউলি বা নদীর ঘাটের কাশফুলের শোভা তাকে বড়ো টানছিল। তাছাড়া পূজার সময়ে বাড়ি এলে পূজার আনন্দ উপভোগ করা আর সবার সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ তো আছেই।
দেবাশিস ছোটো থেকেই মেধাবী ছাত্র, অঙ্কের প্রতি বিশেষ ঝোঁক। ক্লাস নাইন থেকে অখিলেশবাবুর কাছে অঙ্ক শেখা আরম্ভ করেছে, তারপর গ্রাজুয়েশন পর্যন্ত স্যারের কাছেই অঙ্ক করা। ওনার প্রেরণাতেই অঙ্কে অনার্স, পরে ডক্টরেট করতে বিদেশ গেছে। স্যারের অত্যন্ত প্রিয়ছাত্র দেবাশিস। স্যারের সঙ্গে কেমন একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে। দেবাশিস জানে যে তার বড় হওয়ার পেছনে তাঁর অবদান বিরাট। প্রতি বছর বিজয়াতে তাঁর বাড়ি গিয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম এবং আশীর্বাদ নিতে দেবাশিস ভোলে না।
এমনিতেই সপ্তমীর দিন ফিরেছে, তারপর পূজার বাকি দিনগুলো দেবাশিসের পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ঠাকুর দেখতে বেরোনো, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির মধ্যে কিভাবে যেন কেটে গেল ! চলে এলো সেইক্ষণ, মাকে বিদায় জানানোর পালা। বিজয়াদশমীর বিষন্ন ঢাকের আওয়াজ মণ্ডপ ছুঁয়ে বিসর্জনের পথে শেষ হলো। দেবাশিস আগেই ঠিক করে রেখেছিল বিজয়াতে স্যারের বাড়ি যাবে। দেখা করে বিজয়ার প্রণাম সেরে আসবে।
বিজয়াদশমীর পরেরদিন দেবাশিস স্যারের বাড়ি এলো। অখিলেশবাবু পড়ার ঘরে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। দেবাশিস ঘরে ঢুকেই স্যারের কাছে চলে এসে জিজ্ঞাসা করলো, “স্যার, কেমন আছেন ?” এরপর স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেল। পায়ের দিকের ধুতি সরিয়ে পাদুটো খুঁজে পেল না। মাথা তুলে তাকাতেই পাশের দেওয়ালে দাঁড় করানো ক্রাচদুটো চোখে পড়লো। জানতে পারলো গতবছর মারাত্মক বাস অ্যাক্সিডেন্টে স্যারের দুটো পা’ই বাদ গেছে। চোখের কোণে চিক চিকে জল নিয়ে দেবাশিস স্যারের হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করলো। অখিলেশবাবু দেবাশিসের মাথায় আশীর্বাদের হাত ছোঁয়ালেন। পা ছুঁতে না পারলেও গুরু-শিষ্যের স্নেহ ও শ্রদ্ধা মেশানো সম্পর্কটা আগের মতোই নির্মল, পবিত্র ও অমলিন ছিল…..