সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ১৭)

দেবমাল্য

চার

কী অবস্থা! ট্রেনই আসেনি, আর সে কিনা ভেবেছিল, ট্রেনে করে এসে স্টেশন চত্বর থেকে জিপ ভাড়া করে তানিয়া কোথায় চলে গেছে! তানিয়া ভেবে কোন না কোন মেয়ের পেছনে ছুটে গিয়েছিল সে। সত্যিই…

খুব ছোটবেলায় কার কাছে যেন ও শুনেছিল, যমজ বাচ্চার কথা। যমজ বাচ্চারা নাকি হুবহু একই রকম দেখতে হয়। অনেক বড় বয়সেও একইরকম পোশাক পরিয়ে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিলে নাকি কেউই চিনতে পারে না কোনটা কে! একজনের শরীর খারাপ হলে অন্য জনেরও হয়। একজনকে মারলে আর একজনেরও গায়ে লাগে। দু’জনের কোনও একজন খেলে অপর জনের নাকি পেট ভরে যায়। দেবমাল্য বহু বার ভেবেছে, এটা কী করে সম্ভব! এ রকম কি সত্যিই হয়! কে যেন একবার বলেছিল, এই পৃথিবীতে একইরকম দেখতে দু’জন মানুষ ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও কারও সঙ্গে কারও দেখা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সারা জীবনেও কারও সঙ্গে কারও মোলাকাত ঘটে না।

এর কিছুদিন পরেই মা-বাবার সঙ্গে কোন সিনেমা হলে যেন ও ‘ভ্রান্তিবিলাস’ দেখতে গিয়েছিল। খুব মজার বই। নায়ক ছিলেন উত্তমকুমার, আর তাঁর ভৃত্য হিসেবে অভিনয় করেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সিনেমায় ওই দু’জনেরই ডবল রোল ছিল। মানে দু’জনেই ছিল যমজ।

এই দিন কতক আগে কোন একটা কাগজে ও একটা নিবন্ধ পড়েছিল। তাতে নাকি কোন এক ফরাসি তাত্ত্বিক অনেক গবেষণার পরে জানিয়েছেন, দু’জন নয়, একই রকম দেখতে অন্তত সাত জন লোককে একই সময়ে পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও দেখতে পাওয়া যায়।

তার মানে তানিয়ার মতো হুবহু দেখতে আরও ছ’জন মেয়ে এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে। তারই একটা এখন বহরমপুরে। তার সামনে দিয়ে জিপে করে একটু আগে হুস করে বেরিয়ে গেছে।

প্ল্যাটফর্মের যে টি-স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা চা খাচ্ছে, সেই স্টলের গায়ে প্রায় চার হাত লম্বা, দু’হাত চওড়া একটা টিনের পাতে বড় বড় হরফে লেখা— চা খাওয়ার উপকারিতা। তার নীচে এক, দুই, তিন, করে পর পর লেখা উপকারের তালিকা।

লেট না করলে ট্রেন কখন ঢুকে যেত। এতক্ষণে হয়তো তানিয়াকে নিয়ে ও হোটেলে পৌঁছে যেত। তা হয়নি দেখে মাইকে কোনও অ্যানাউন্সমেন্ট হলেই ও সঙ্গে সঙ্গে কান খাড়া করে দিচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে আসার পর অন্তত পাঁচ-ছ’বার ঘোষণা হয়েছে লালগোলা প্যাসেঞ্জার পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেটে আসছে।

পঁয়তাল্লিশ মিনিট তো নয়, যেন পঁয়তাল্লিশ বছর। যতই স্বাভাবিক থাকার ভান করুক না কেন, আসলে ভেতরে ভেতরে কিন্তু ভীষণ টেনশন হচ্ছে তার। আসার সময় ওই জিপ আর জিপের ভেতরে অবিকল তানিয়ার মতো দেখতে ওই মেয়েটাকে না দেখলে হয়তো তার এ রকম হতো না। কিন্তু কী করা যাবে!

মনের এই অস্থিরতা দূর করার জন্যই চায়ে চুমুক দিতে দিতে ‘চা খাওয়ার উপকারিতা’ পড়তে লাগল সে। লেখার ধরন আর মাঝে মাঝেই চলটা উঠে গিয়ে টিনের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা আদ্যিকালের। তা ছাড়া এ ধরনের বিজ্ঞাপন তো বহু যুগ আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। যখন এই প্ল্যাটফর্ম হয়, তখনই বোধহয় এই চায়ের দোকানটা হয়েছিল। এবং সেই সময়ই সম্ভবত এই টিনের বোর্ডটা লাগানো হয়েছিল। যিনি চায়ের দোকানটা করেছিলেন, তারই নাতি-নাতনির ছেলে কিংবা কয়েক হাত ঘুরে অন্য কেউ হয়তো এই চায়ের দোকানটা এখন চালাচ্ছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।