T3 || ঘুড়ি || সংখ্যায় দিলীপ কুমার ঘোষ

আকাশের ঘুড়ি

আমি জীবনে একটাও ঘুড়ি ওড়াইনি। কিন্তু ঘুড়ি থেকে খুব যে দূরে থেকেছি, তা-ও নয়। আমার ঘুড়ি আকাশে না-উড়লে কী হবে, আমার মনের আকাশে ঘুড়ি উড়েছে। ছোটবেলায় আকাশটা অনেক বড় ছিল। প্রত্যেকেরই ছোটবেলায় যেমন আকাশ বড় মনে হয়, তেমন বড়র কথা বলছি না। আক্ষরিক অর্থেই আমার শৈশবে আকাশ ছিল অনেক বড়। সেসময় আমাদের এদিকে ছিল টালির চালে ছাওয়া সব ঘরবাড়ি; আর ছিল দু’চারটে ছাদওলা একতলা, দোতলা-তেতলার পাট প্রায় ছিল না বললেই চলে। ছিল মাঠে মাঠে চাষবাস, বাগানে আম-কাঁঠাল-কলাগাছের সারি। আজকের মতো বাঁশঝাড়ে ভরে যায়নি কৃষিজমি আর ডাঙা। বাড়িঘরদোর-গাছপালা ছাড়িয়ে দেখা যেত অনেকটা বেশি আকাশ।
আমাদের এদিকে আকাশে ঘুড়ি উড়ত অগ্রহায়ন-পৌষে— কার্তিক পুজো থেকে আরম্ভ করে আক্ষিণ দিন পর্যন্ত। আক্ষিণ কথাটা আমাদের এদিকে আজও চলে। পৌষ সংক্রান্তির দক্ষিণ অয়নান্ত দিবস আমাদের এখানে যেন কেমন করে বদলে গেছে আক্ষিণ দিনে। তা নিয়ে অবশ্য আক্ষেপের কোনও কারণ ঘটেনি। এ দিনই আমাদের এখানে আকাশ সবচেয়ে ঘুড়িবহুল হয়ে ওঠে। অতীতেও হত, আজও হয়। ইদানীং অবশ্য দেখি কার্তিক পুজোর আগেই আকাশে ঘুড়ি উড়ছে। তবে এখনও বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি ওড়ানোর রীতি চালু হয়নি।
শৈশবে আমার না ছিল লাটাই, না ছিল সুতো, না ছিল ঘুড়ি। তবে সুতো যে একদম ছিল না, তা নয়। এদিকে-ওদিকে বাঁশঝাড়ে-আমবাগানে-ঝোপেঝাড়ে আটকে থাকা সুতো ঠিক কিছুটা জোগাড় হয়ে যেত। প্যাঁকাটি(পাটকাঠি)-কঞ্চিতে জড়িয়ে রাখা সেই সুতো দিয়ে ঢিলিপ্যাঁচ খেলার সময় বলতাম, ‘কুচকুচে মাঞ্জা ধোয়া সুতো’। মাঞ্জার কথায় সেই এসেই পড়লাম।। তখন সুতো মাঞ্জা দেওয়া ছিল গ্রাম্য-কিশোরজীবনে একটা বিশেষ ঘটনা। মাঞ্জার ঘনঘটা কম ছিল না। কাচগুড়ো-ময়দার আঠা-বেল আঠা-গাব আঠা-অ্যারারুট-ভাতের মাড়-রং সবকিছু ফুটিয়ে মণ্ড করা হত। সেই মণ্ডই ছিল মাঞ্জা। অবশ্য মাঞ্জা তৈরির আগে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন রকমের কাচ জোগাড় করে হামানদিস্তায় গুঁড়ো করা কম ঝকমারি ছিল না। দোকান থেকে কেনা কাঁচা সুতো কিছুটা ব্যবধানের দু’-তিনটে গাছে বেশ কয়েক পাক ঘুরিয়ে আটকানো হত। তারপর থকথকে মাঞ্জা কাপড়ে নিয়ে হাতের শক্ত টিপুনিতে সুতোয় ভাল করে লাগিয়ে নেওয়া হত। এই মাঞ্জা দেওয়া সুতো রোদে ভাল করে শুকিয়ে তারপর লাটাইয়ে জড়িয়ে নিলেই কেল্লা ফতে— প্রস্তুত ঘুড়ির মরশুমে জোরদার প্যাঁচ খেলার রশি। আমি নিজের সুতোয় কোনওদিন মাঞ্জা না দিলেও মাঞ্জা দেওয়ার কাজে কেমন করে যেন ঠিক জুটে যেতাম।
ঠিক যেমন ঘুড়ি ওড়ানোর সময় নিজে ঘুড়ি না ওড়ালেও অপরের ঘুড়ি ওড়ানোর সুবিধার্থে তোলাই দেওয়ার জন্য কাগজের ঘুড়ি ধরে অনেকটা পিছনের দিকে হেঁটে যেতাম। শুধু তাই নয়, অন্যের ঘুড়ি ওড়ানো মনোযোগ সহকারে দেখতাম। খেয়াল করতাম প্যাঁচ খেলার সময় লাটাইটা কীভাবে দু’হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর ভাঁজে রেখে সুতো ছেড়ে লক দেওয়া হচ্ছে অথবা লাটাইটা কীভাবে দু’হাতে চেপে ধরে খ্যাঁচ মারা হচ্ছে। অন্যের ঘুড়ি কেটে গেলে আমাদের এদিকের আরও কয়েকজনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘দুবো হো’ বলতাম, আর এদিকের ঘুড়ি কাটলে ওদিক থেকে ভেসে আসা ‘দুবো হো’ শুনে মনখারাপ করতাম।
কাটা ঘুড়ির পিছনে খুব কম ছুটেছি। আমার পক্ষে কাটা ঘুড়ি লোটা প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ আমার না ছিল ঘুড়ি লোটার বড় লগা, না ছিল দ্রুত দৌড়ানোর মতো সবল দুই ক্ষিপ্র পা, না ছিল বাঁশঝাড়-আমগাছ-নারকেলগাছ বাওয়ার দক্ষতা। তবে কোনও কোনও বছরে দু’-একটা ঘুড়ি আমার কাছে হাজির হত। অপরের চোখে না পড়া ঘুড়ি বাবু (বাবাকে ‘বাবু’ বলতাম) মাঠ থেকে বা মা বাঁশবাগান থেকে আমাকে এনে দিত। আর আমি সেগুলোকে যত্ন করে রেখে দিতাম, ঠিক যেভাবে রাখা থাকত আমার কোনওদিনই না খেলা কিছু কাচের গুলি।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।