নার্সিংহোমের অদূরে একটা পার্ক। এই সকালে পার্কে কোন মানুষজন নেই। একটা বেঞে বসে আছে সুদর্শন আর বিকাশ। দু জনের হাতে নি:শব্দে পুড়ছে সিগারেট ।অনেকটা সময় নি:শব্দে কাটিয়ে সুদর্শন বলল,’ ভুল হয়ে গেল।’
‘কি ভুল হলো? ‘ বিকাশ প্রশ্ন করে।
‘বাবাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করানো’।
বিকাশ অবাক হয়ে বলে, ‘কি বলছিস তুই?’
‘অন্যায়টা কি বললাম, বল?’
‘বাবার ওপর তোর কোন ডিউটি নেই?’
‘ডিউটি শুধু আমার একার?’ ‘
‘ তুই কি বলতে চাইছি বলতো’?
‘ আজ সে কেন আমাকে ডাকলো’?
‘ তাহলে কাকে ডাকবে? ‘
‘তাহলে সেদিন কেন আমায় তাড়িয়ে দিয়েছিল? সেদিন ওনার মনে হয়নি যে, ছেলেকে একদিন দরকার হতে পারে?
‘ একটা কথা। তোকে ডেকেছে তোর মা। বাবা কিন্তু নয়।’
সুদর্শন চুপ।
‘ আর শোন, তোকে অনাথ করে তাড়িয়ে দেননি। এম এস সি পড়িয়েছেন।’
‘নয়ের দশকে শুধু পড়াশুনাকে মুলধন করে কেউ বাঁচতে পারেনি। তখন অনেক শিক্ষিত ছেলে আত্ম হত্যা করেছে। তুই যদি সেদিন আশ্রয় না দিতিস, হয়তো আমাকে সেই পথ বেছে নিতে হতো’।
‘ যারা আত্ম হত্যা করে, তাদের ভিতর আত্ম বিশ্বাস ছিল না। আর তোকে আশ্রয় নেবার আমি কে? দিয়েছে ওপরওয়ালা।’
‘ আমি সায়েন্সের ছেলে, ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। ‘
‘ ডাক্তারও সায়েন্সের ছাত্র। যখন অপারেশন করতে যায়, তখন ছুরিটা কপালে ঠেকিয়ে নেয় কেন? ‘
বিকাশ চুপ।
‘ শোন, তোকে একটা কথা বলি, আমারএক বন্ধু বি সি রায় হাসপাতালের শিশুদের ডাক্তার। একদিন ওর হোস্টেলে গেছি আড্ডা দিতে তখন সৌরভ কথায় কথায় বলল, দেখ কত শিশু অসুস্থ হয়ে এখানে ভর্তি হয়। সবাই কি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে? কেউ মারাও যায়। এসবের পিছনে আমাদের কোন হাত নেই। ঈশ্বর ওর কপালে লিখেছে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা তাই ফিরেছে। আমরা উপলক্ষ্য মাএ। না হলে কত শিশুকে বাঁচাতে চেষ্টা করি। পারি না। ঈশ্বর আমাদের ক্ষমতার একটা লেভেল ঠিক করে দিয়েছে। আমরা ঐ পর্যন্ত যেতে পারি। তারপর আমাদের আর কিছু করার থাকে না। তখন আমরা বলি, ঈশ্বরকে ডাকুন। ‘
‘ একজন ডাক্তার এই কথা বলেছেন? ‘
‘ একজন নয়। সব ডাক্তারই একটা সময়ের পর এই কথা বলেন। ‘
‘
কিন্তু আমার বাবা কোনদিন ঈশ্বর মানতেন না।’
‘ তোর মনে হতে পারে। কোন ডাক্তারকে দেখে আমরা বলবো, উনি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন? বলবো না। তাই তো? ‘
‘ আমার বাবা কোনদিন পূজো করেন নি। শুধু কাজে যাবার আগে দরজার ওপরে কালির অস্পষ্ট ছবিটা নমস্কার করে বের হতেন। ‘
‘ তা হলে এটা কি? ‘
‘ বাবা শুধু কাজ আর কাজ বুঝতেন’।
‘ তাই তো তিনি আজ একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। শোন, আর একটা কথা তোকে বলি। একবার একজন সারদা মাকে বলেছিল, আপনি তো সাধুদের দিয়ে ব্যবসা করাছেন’? তখন সারদা মা কি বলেছিল জানিস?’
‘না।’
তবে শোন। সারদা মা সেই মানুষটিকে বলেছিল আমার ছেলেরা কি সারাদিন ধ্যান জপ করবে? কেউ তা করতে পারে? কর্ম তাকে করতেই হবে। এই কর্ম এক রকম ধ্যান জপ। ‘
‘ একদম ঠিক কথা বলেছে’।
‘ এই যে তুই বলছিলি না, বাবাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করানো ভুল হয়েছে। কেন? না, এই বাবা তোকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল। তাই জন্য তো তুই একথা বললি। মানে বাবা অপরাধী। সারদা মা বলতেন, কারো দিকে একটা আঙুল তুলে দোষী বললে, বাকি আঙুল গুলো তোমার দিকে দেখায়। মানে তুমি তার থেকে বেশী অপরিধী। ‘
‘ কিন্তু সেদিন তুই বলেছিলিএমন অদ্ভুত মানুষও
হয়! আজ একথা বলছিস কেন? ‘
‘ সেটা ছিল 1993।আজ 2010।সময় মানুষের চিন্তা ভাবনা পাল্টে দেয়। ‘একটু থেমে বিকাশ বলে,’ চল ডাক্তার রায় রাউন্ডে এসে যাবেন’। –
ওরা পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। বিকাশ বলে, ‘এবার মেশোমশাইকে তোর কাছে নিয়ে আয়।’
‘আসবেন না।’ ‘
‘ তুই বল না। ‘
‘ বললেও আসবেন না। আমার বাবাকে আমি চিনি না। ‘
‘ তুই যে বাবাকে চিনতিস, আজ হয়তো তিনি সেই বাবা নেই। ‘
‘ না, না। আমার বাবার কোন পরিবর্তন নেই। তিনি একই রকম আছেন।’
‘হতে পারে না। তুই আমি কি পালটাই নি? মানুষ পরিবর্তনশীল জীব। তাকে পাল্টাতে হবেই। না হলে সে এই পৃথিবী থেকে আউট হয়ে যাবে। যেমন হয়েছে ডাইনোসর, বুঝলি।’
‘তুই বলছিস বটে। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না’।
‘কেন হচ্ছে না? তুই কি ইতিহাস পড়িস নি? শোন মানুষ পাল্টায়। তাই প্রস্তর যুগ থেকে মানুষ আজ বিজ্ঞানের যুগে এসেছে। ‘
নার্সিংহোমের ভিতর ঢুকে পড়েছেওরা। লিফট উপরে উঠছে। বিকাশ বলল,’ একবার বাবাকে বলে দেখিস। উনি কি বলেন। তবে এখন নয়। উনি ছুটি হয়ে বাড়ি ফিরুক, তখন বলবি। ‘
‘ সত্যি যদি বাবা আমার কাছে চলে আসে তবে সবচেয়ে খুশি হবে কৌনিশ। যে আজও আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদে। আর বলে, দাদাকে এখানে নিয়ে এসো বাবা। দাদা আমার বন্ধু হবে। তোমরা অফিস চলে গেলে আমি বড় একা হয়ে পড়ি। দাদা হবে আমার বেস্ট ফেন্ড।
বিকাশ হঠাৎ অনুভব করে তার চোখ জূড়ে বৃষ্টি নেমেছে। অথচ আকাশে একটাও মেঘ ছিল না। আজ সে বুঝতে পারলো, মেঘ ছাড়াও কখনো কখনো পৃথিবীতে বৃষ্টি হয়!