সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দেবদাস কুণ্ডু (পর্ব – ১৩)

লড়াইয়ের মিছিল

পর্ব – ১৩

‘কি করতে হাটে আসিস? দেখিস না পুলিশ আসছে। সুশীলের গলায় রাগ ঝরে পড়ল।শংকর তোতলাতে থাকলো, ‘আমি তো খেয়াল করিনি দাদা। একটা কাস্টমার তখন থেকে মাল দেখে যাচ্ছে, নিচ্ছে না। আমি ওর দিকে নজর রাখছিলাম। যদি মাল জেরে দেয়।‘
‘শুধু একদিকে নজর দিলে হবে? কি করে তুই ব্যবসা করে খাবি বলতো? চিরকাল কি আমি তোর পিছনে থাকবো।বিয়ে সাদি করেছিস।মেয়ে হয়েছে দুটো। এখনও যদি না সামলাতে পারিস কিভাবে সংসার চালাবি?
সুশীল রাগে গজ গজ করে কথাগুলো বলল মাল গোছাতে গোছাতে।
শংকর হাসে। বলে, ‘এখন তো সবে আটটা বাজে। এর মধ্যে চলে আসবে কে জানে? ‘
‘ঘড়িটা হাতে পড়েছিস জব্বার। এতো বড় ঘড়ি চোখে পড়ে না কটা বাজলো? সুশীল ক্যাশের থলিটি প্যান্টের পকেটে ভরে নেয়। এখন যেতে হবে থানায়। খসবে কিছু টাকা’
‘সবে আটা দশ। দশ মিনিট দেরি হলো কি মাল তুলে নিয়ে যাবে? শংকরের গলায় বিস্ময় ।
, ‘এতো দিন হাটে আসছিস পুলিশের চরিএ বুঝতে পারিস না? ‘সত্যি তুই কি করে খাবি ভাই? ‘
শংকর আবার দাঁত বের করে হাসে।
, ‘হাসলে হবে না ভাই। ওরা শকুন। এই শহরে এখন শকুন দেখতে পাস? সব শকুন মরে পুলিশ হয়েছে এক একটা শকুন। ‘
‘দাদা ওরা শকুন নয়। ওরা বাজপাখি।কেমন এলো আর মূহুর্তের মধ্যে দু বান্ডিল মাল তুলে নিলো বাজ পাখির মতো। ‘
‘তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। আচ্ছা শোন মালপএ গুছিয়ে ভ্যানে করে বাড়ি চলে যা। আমি থানায় যাচ্ছি। সকালবেলা আজ তেমন বেচাকেনা হলো না। শুক্কা শুক্কা দুশো টাকা গচ্চা যাবে। ‘
শংকর কিছু বলে না। ভ্যানে তুলতে থাকে গাট্টি। সুশীল বড় তলা থানার দিকে পা বাড়ায়।
এই রাস্তাটা রাজা দীনেন্দ স্টীট। শ্যামবাজার থেকে শুরু হয়ে মানিকতলা পর্যন্ত গেছে। ও পাশে গৌরি বাড়ি লেন। সোজা গেলে এ পি সি রোড। এই বিশাল এলাকা জুরে রাত থাকতে বসে হরিশা হাট। পুরো নাম হরি সাহা। এই হরি সাহার বর্তমান বাড়ি গ্যালিফ স্টীটে। বেশ বড় বাড়ি। সেখানে আছে হরি মানে কৃঞ ঠাকুরের বিরাট মন্দির। শ্যামবাজার থেকে সোজা মানিকতলা দিকে এলে খান্না মোড় পার করলে ডান হাতে পড়বে গাড়ি বারান্দা সমেত বড় বাড়ি। এই বাড়ির নীচ তলায় বসে হাট। প্রথম দিকে শুধু এই বাড়ির ভিতর এবং গাড়ি বারান্দার নিচে সবতো হাট। তাই হরিশা হাট এর নাম। বর্তমানে সেই হাট হাত পায়ে ছড়িয়েছে বিস্তর। বসে রবিবার আর বুধবার। গ্রাম গঞ্জো ভিন প্রদেশ থেকে পাইকারি ব্যবসাদাররা চলে আসে আগের দিন। থাকে হোটেলে। রাত বারোটা থেকে শুরু হয় কেনাবেচা। ম্যাটাডোরে ওঠে মাল। যায় হাওড়া শিয়ালদহে। তারপর পার্সেলে বুক হয় মাল। চলে যায় দূর গ্রাম মফস্বল শহর ভিন রাজ্যে। লাখ লাখ মানুষ এই হাটে জীবিকা অর্জন করে। এতো বিশাল হাট দেখা যায় না। এখন করোনার জন্য দীর্ঘ কাল বন্ধ ছিল। আবার খুলেছে। কিন্তু এখন দুটো থেকে ভোর আটটা পর্যন্ত হাট চলে। করোনা আগে বেলা দশটা বারোটা পর্যন্ত চলতো হাটের লেনদেন। এই হাটে শুধু জামাকাপড় কেনাবেচা হয় না। তার পাশে লেনদেন হয় মশারি কাট পিস গামছা। শাড়ি সায়া। ব্লেট পার্স বিছানার চাদর শীতের জ্যাকেট বর্ষার রেনকোট। বাচ্চাদের রঙিন জুতো আরো কত কিছু। আগে ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নেমে আসতো হাট। ট্র্যাফিক জ্যাম হতো অরবিন্দ সরনীতে। এখন আর রাস্তায় বসতে দেয় না। সময় কাট ছাট করেছে। পুলিশ আগে পয়দা নিতো কিছু বলতো না। দশটার পর মাল তুলে নিয়ে যেতো। এখন সেটা আটটা হয়েছে। করোনা মানুষের জীবন জীবিকা পাল্টে দিয়েছে। কতো লোক কর্ম হীন হয়েছে। কেউ কেউ অভাবে আত্ম হত্যা করেছে। কেন মানুষ আত্ম হত্যা করে? তার জীবনে তো অভাব ছিল। তীব্র অভাব ছিল। ধানকলের বস্তিতে ছোট্ট ঘরে তারা চারটে প্রানী থাকতো। তখন সদ্য পাকিস্তান থেকে এসেছে। এর তার কাছে কাজ করে। একবেলা খায় তো অন্যবেলা অভুক্ত। শেষে কাকার কাছে কাজে ঢুকলো। সেখানে হাট করা শিখলো। মাল কাটিং শিখলো। ভ্যান চালানো শিখলো। কিভাবে খরিদ্দার সামলাতে হয় তা জানলো। বড় বাজার থেকে মাল আনা শিখলো। সব শিখেছে কাকার হাত ধরে। একদিন কি নিয়ে লাগলো কাকার সংগে ঝগড়া। চলে এলো। নিজে দিল ব্যবসা। তারপর শুরু হলো আর এক লড়াই। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াই।
বড় তলার থানায় ঢুকে সুশীল দেখলো থানায় আজ খুব ভিড়। মাল ছাড়াতে কতো বেলা হবে কে জানে। আজ আর দুপুরে রেস্ট হবে না। সারারাত জাগা। চোখ দুটো বুজে আসছে। তবু সে চেয়ে রইল। আবার আত্ম হত্যার কথা মনে পড়ল। কি করে পারে মানুষ নিজেকে শেষ করতে? । তার তো মনে হয় আত্মহত্যা কাজটা অনেক কঠিন। তার চেয়ে বাঁচার লড়াই অনেক আনন্দের।প্রতিদিন বাঁচা মরা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দুলতে থাকে বুকে। আর তখন আরো জেদ চেপে যায়। না হারবো না। রক্ত মাংস হাড় দিয়ে লড়বো প্রতিখনে। দেখা যাক এই লড়াইয়ে কে জেতে? জীবন না মরন? সেদিন গুলিতে কোথা থেকে যেন এক অপরিসীম শক্তি এসো যেতো রক্তে। একবারের জন্য কখনো মনে হয়নি আত্ম হত্যা করি। আর এরা দেখ। কেন তাদের একবারের জন্য মনে হয় না জীবনে তো জোয়ার ভাটা আছে। পৃথিবীতে আলো অন্ধকার আজে।জ্যোৎস্না আছে আমাবস্যা আছে। সুখ আছে দু:খ আছে। পড়ে যাওয়া আছে। আবার উঠে দাঁড়ানো আছে। এতো জীবনচকরো। এ তো লড়াই। এই লড়াইয়ের ভিতর আছে বিষ আর অমৃত। বিষটা ফেলে দিয়ে অমৃতটা নিতে জানতে হয়। এই জানাই আনন্দ। এই জানাই বেঁচে থাকা। কেন জীবন থেকে পালিয়ে আত্ম হত্যাকে বরন করবো?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।