Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ক্যাফে স্মৃতিচারণায় সঞ্জীবন হাটী

maro news
ক্যাফে স্মৃতিচারণায় সঞ্জীবন হাটী

ঋতুবিয়োগের বছরদশ

নিভে আসা অপরাহ্ন। দড়ি কলসি হাতে ঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিনোদিনী। মহেন্দ্র তাকে সংসার দিতে পারেনি। বিহারীও তার বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। অকাল বিধবা, সুন্দরী, শিক্ষিতা বিনোদিনীর তো ভারী নিস্পাপ একটা ইচ্ছে ছিলো। সংসার করার ইচ্ছে। যখন তার সব আলো এক এক করে নিভে গেলো, তখন মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুর কথাই মাথায় এলোনা তার। সে ঘাটে পৌঁছল। নিজেকে শেষ করে দেবে। প্রস্তুত। ঠিক সেই মুহূর্তে সামনের ঘাটে গ্রামের গৃহবধূরা কোনো শাস্ত্রীয় আচার পালন করতে আসে। নেমে আসা সন্ধ্যের অন্ধকার কেটে তাদের হাতে জ্বলে ওঠে মঙ্গলদীপ। উলুধ্বনিতে চাপা পড়ে যায় বিজন শূন্যতা। বিনোদিনী অমোঘ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। স্থির। ওর মাথার ওপর তখন নক্ষত্রখচিত

আকাশ। অন্তহীন। বিপুল বিস্ময়ে যখন সেদিকে দেখে ও, কলসি হাত থেকে গিয়ে পড়ে জলের মধ্যে। ডুবে যায় নিজেই। মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে জীবনের এই বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে হয়তো বিনোদিনীর মনে হয়, আমি কি সত্যিই এতোটাই ছোটো, এতোটাই দুর্বল আমার জীবনের উদ্দেশ্য? কেবলমাত্র প্রিয় পুরুষের কাছে প্রেম পাইনি বলেই কি এই সমগ্র জগৎ আমার কাছে মিথ্যে?

সেদিন বিনোদিনী বাঁচার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন তার পৃথিবীটা একটা বাড়ি, দুটো মানুষের চৌহদ্দি পেড়িয়ে অনাবিলভাবে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। যে আঘাত তাকে আত্মহননের দিকে এগিয়ে দিয়েছিলো, সেই আঘাতই তাকে তার থেকেও অনেক বড়ো করে দেয়।

যতই ঝড় আসুক, জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে কষ্ট যতই গাঢ় হোক, যতই মনে হোক যে এই যন্ত্রণা আর নিতে পারবোনা, এর থেকে চলে যাওয়াই শ্রেয়, আদতে যে আমি তার থেকেও অনেক বড়ো, এবং সেই ব্যাপ্তির সামনে যে আসলে যেকোনো

প্রতিবন্ধকতা মাথা নত করতে বাধ্য, ‘চোখের বালি’র এই দৃশ্যটা বড়ো অবলীলায় তা বুঝিয়ে দেয়।

এই ছাব্বিশ বছর বয়সে সময়ে অসময়ে, ব্যর্থতায়, মন খারাপে যে কতবার এই দৃশ্যটুকু আমি দেখেছি তার কোনো হিসেব হয়না।

ঋতুপর্ণ ঘোষ বলতে আমার মনে সব থেকে প্রথমে এই ছবিটাই ভেসে ওঠে।

তখন সম্ভবত ক্লাস ফোর। এক আত্মীয়ের বাড়িতে টিভিতে দেখেছিলাম ‘চোখের বালি’র সেই সেনসুয়াস দৃশ্য। আশালতাকে ব্লাউজ পড়তে শেখাচ্ছে বিনোদিনী। সেই প্রথম জানলাম ঐশ্বর্য রাই বাংলা ছবিও করেছে, আর যে লোকটা তাকে বলিউডের গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড থেকে টেনে এনে সাদা থান পরিয়েছে, তার নাম ঋতুপর্ণ।

একটা ভালো বই যেমন যতবার পড়া হয়, নতুন করে আবিস্কার করা যায়, একটা ভালো ছবিও

হয়তো তাই। এই সিনেমার বিস্তৃতি তেমনই প্রেম, বিয়ে, প্রত্যখ্যান, বিরহ সবকিছুর মধ্যে দিয়ে গিয়েও কোনো এক অসীমের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ছবি শেষে বিনোদিনী ওর সই আশালতাকে যে পত্র লেখে, তার শেষটা এরকম, ‘ তোর পেটে যে সন্তান … সে ছেলেই হোক বা মেয়েই হোক, দোহাই বালি, তাকে দর্জিপাড়া স্ট্রিটের দো’তলার বাড়িতে আটকে রাখিস না, দেখবি সত্যিকারের দেশ কাকে বলে সেই একদিন তোকে বুঝিয়ে দেবে। ‘

এই যে বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে নিজেকে টেনে বার করে নিয়ে গিয়ে এই মহাবিশ্বের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, নিজের একটা বিশাল সত্ত্বার মুখোমুখি নিজেকে হাজির করা – এই জীবনদর্শনের জন্যই আরও অনেকের মতন আমার কাছে ঋতুপর্ণ উপাস্য।

আমরা সবাই কখনো না কখনো ‘উনিশে এপ্রিল’-এর অদিতি। আমরা সবাই কখনো না কখনো ‘দোসর’-এর কাবেরী। বাড়িতে প্রতিদিন কত

হাজার আপোশ নিজেদের সঙ্গেই আমরা করে চলেছি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার নিজেদেরকেই কতভাবে ভুল বোঝাচ্ছি। শুধুমাত্র কষ্ট পাবে বলে আমাদের কাছের মানুষদের কত চাপিয়ে দেওয়া বোঝা আমরা নিরন্তর বয়ে চলেছি। ওঁর ছবি দেখা মানে সেই নিজেদেরকেই খুঁজে পাওয়া, সেই চাপা কষ্টটা চোখের সামনে দেখেই স্বস্তি বোধ, ক্যাথারসিস। এ তো আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে ওঁর লিপস্টিক আর গয়নার বাইরে গিয়ে আমরা ওঁর থেকে শিখতে পারলাম না।

ক’দিন আগে সুপ্রিম কোর্টে সেমসেক্স ম্যারেজের হিয়ারিং এ সি জি আই চন্দ্রচূড় যখন বলছিলেন, ‘ দেয়ার ইজ নো অ্যাবসোলিউট কন্সেপ্ট অফ বায়োলজিক্যাল ম্যান অ্যান্ড ওম্যান ‘, মনে পড়ছিল ‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবির কথা। এগারো বছর আগে তৈরী সেই ছবিতে উনি বলেছিলেন, ‘ জাস্ট বি হোয়াট ইউ উইশ টু বি। ইটস ইয়োর উইশ ‘। নশ্বর শরীরের থেকে অবিনশ্বর আত্মার গুরুত্ব যে অনেক বেশী, সেই আধ্যাত্মিক বার্তাটুকুও বড়ো

সুক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছিলো এই সংলাপে। এ তো আমাদের মানসিক সীমাবদ্ধতা যে এই ছবির সেরকম মূল্যায়ন আমরা দরদ দিয়ে করতে পারিনি।

গত চার বছরে ‘ফার্স্ট পার্সন’ বহুবার আমার গাইড হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক জটিল সমস্যা যেন সহজ হয়ে গেছে। ওঁর প্রত্যেকটা সৃষ্টি এক একটা প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে আমরা বাঁচার রসদ পেতে পারি, লড়াই করার ক্ষমতা পেতে পারি, নিজেকে সঙ্গী করে ভীষণ ভাবে ভালো থাকার একটা অদম্য স্পৃহা পেতে পারি।

ক’বছর আগেও ঋতুপর্ণ নামটা শুনলে মন খারাপ হয়ে যাওয়া ছবির কথা মনে পড়তো। কুয়াশা ঘেরা পাহাড়, রুমালে নাক মোছা, গুনগুন করে রবিঠাকুর। এখন আর সেটা মনে হয়না। ‘মন খারাপের দিস্তা’ থেকে সরে গিয়ে এখন ‘ক্রাউনিং উইশ’র কথা মনে পড়ে। অন্ধকারে বসে, করুণ চোখে তাকিয়ে কান্নাকাটি তো হলো অনেক। এবার নাহয় সেলিব্রেশন হোক। নিজের মতন করেই,

একা একা।

যেমন ‘দহন’ ছবিতে বলে গিয়েছিলো লোকটা,

‘চারদিকের সম্পর্কগুলো যেমন আছে, থাক না। তাদের ওপর ডিপেন্ড না করলেই হলো। এতোদিন শুধু একা চলার কষ্টটা ভেবে ভয় পেয়েছি। কিন্তু তার আনন্দটা? সেটা থেকে নিজেকে আর বঞ্চিত করতে চাইনা।‘

ঋতুপর্ণ, চলে যাওয়ার দিনে আপনাকে আবারও নতুন করে প্রণাম, শ্রদ্ধা, কুর্নিশ। ভাগ্যিস এই ছবি আর লেখাগুলো হয়েছিলো, মন খারাপ হওয়া লম্বা রাতগুলোয় নাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম !

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register