Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ক্যাফে ধারাবাহিকে সুকুমার রুজ (পর্ব - ৬)

maro news
ক্যাফে ধারাবাহিকে সুকুমার রুজ (পর্ব - ৬)

ম্যারিটাল প্লাস্টার

সেই বড় রাস্তা অবধি খুঁজে এলাম। কোথায় যে থাকেন বাবু? তুমি কোথায় থাকো উল্লুক? আমার পঞ্চাশ টাকা গচ্চা গেল। এতো লোকের সামনে উল্লুক বলবেন না স্যার! ইউনিয়নে জানালে আর কোনোদিনও ড্রাইভার পাবেন না। আমি গাড়িতেই ছিলাম। আপনার দেরি হচ্ছে দেখে মাসিমা বললেন, 'বাবুকে খুঁজে নিয়ে আয়।' তাই বড় রাস্তায় গিয়েছিলাম। কেতাত্থ করেছিলে! এখন চলো। আমার তো পঞ্চাশ টাকা গেল! বাবু আমি কী করব! দাদাবাবু আর দিদিমনি ডাক্তারবাবুর বাড়ি নিয়ে যেতে বলল যে! ভালো করেছ, এবার আমাকে আর তোমার মাসিমাকে বাড়ি নিয়ে চলো।

আট বেশ কিছুক্ষণ কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খোলে নেপাল — আসুন স্যার! সিভিল ড্রেসে না এসে ইউনিফর্মে এলেই ভালো করতেন স্যার। দেখে সবাই ভয় পেত। বুবাই ও টুকুন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারপর প্রশ্ন করে — ইউনিফর্ম কোথায় পাবো? কিসের ইউনিফর্ম? নেপাল মিটিমিটি হেসে বলে— আমি হলাম নেপাল। ডাক্তারবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমার কাছে লুকোনোর দরকার নেই। তাছাড়া তারা সব পালিয়েছে। শুধু এমিলি দিদিমনি থুরি লক্ষ্মী দিদিমনি আছে। চানে ঢুকেছে। মেয়ে পুলিশ এনেছেন, ভালো করেছেন। লাগতো, যদি দিদিমনি এখনও অজ্ঞান থাকতো। যান, বাবু ঘরে আছেন। বাবুর কাছেই সব শুনুন। আমি এখখুনি আসছি স্যার। পুলিশকে নেপালের খুব ভয়। ও ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’। তাই ও বুবাই ও টুকুনকে পুলিশ ভেবে ওদের ছোঁয়া বাঁচাতে সটকান দেয়। বুবাই ও টুকুন কিছু না বুঝে ভেতরে এগোয়। দেখে, ডাক্তারকাকু ঘরের মেঝেয় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। চারপাশে সব লন্ডভন্ড অবস্থা। চেয়ার টেবিল উল্টে রয়েছে, ওষুধের দানা, শিশি কাগজের পুরিয়া এসব ঘরের মেঝেয় ছড়ানো। ডাক্তার সরখেল ওদের দেখে বলেন — ও তোমরা! আমি ভাবলাম পুলিশ। পুলিশ আসবে কেন কাকু? আর বলো না। এতক্ষণ যা কুরুক্ষেত্র কাণ্ড গেল! ঘরের অবস্থা দেখছ না, তোমাদের যে কোথায় বসতে দিই! বুবাইয়ের মনে পড়ে যায় ফোনের কথা। ও বলে ওঠে— কাকু বাইরেই বসি না হয়। না না বাইরে কেন! তোমরা তো আর রুগী নও। তোমরা বরং দোতলায় কাকিমার কাছে গিয়ে বসো, আমি একটু পরে আসছি। এখুনি হয়তো পুলিশ আসবে। ওদের কাছে ডায়েরিটা লিখিয়ে ওপরে যাচ্ছি। পুলিশ কেন কাকু! কোনও সমস্যা? সব বলবো ওপরে গিয়ে। তোমরা বরং ওপরেই চলে যাও শিগগির। পুলিশ এলে তোমাদেরকে দেখলে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ছাড়বে না। সে আর এক হ্যাপা। এমন সময় বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে লক্ষ্মীমনি। সদ্য স্নান করা লক্ষ্মীমনিকে দেখতে খুব ভালো লাগছে। শিশির ভেজা গোলাপ যেন! ফরসা মুখ, গোলাপ পাপড়ির মতো ঠোঁট। এখন আর চোখে মুখে টেনশনের ছাপ নেই৷ চুলের ডগা থেকে দু-এক ফোঁটা জল ঝরে পড়ছে। ওকে দেখেই চমকে ওঠে বুবাই! এতো সেই কলেজের লক্ষ্মীমনি! একটু যেন রোগা হয়েছে লক্ষ্মীমনিও বুবাইকে দেখে চিনতে পেরেছে। ও কেমন থমকে গেছে। আবার বাথরুমে ঢুকে পড়ার উদ্যোগ নিতেই ডাক্তারবাবু বলে ওঠেন — লজ্জা কি গো মা, ও আমার নিজের লোক। এসো, এদিকে এসো। লক্ষ্মীমনি মুখ নীচু করে ঘুরে দাঁড়ায়। বুবাইয়ের ওপর ওর এক বুক অভিমান জমা হয়ে আছে। তাই চিনতে পেরেও কোনও কথা বলতে পারছে না। বুবাই বলে ওঠে — তুই মানে তুমি লক্ষ্মীমনি তো? লক্ষীমনি ঘাড় হেলায়। তারপর যেন মরিয়া হয়ে বলে ওঠে — তোমাদের দুজনকে দারুন মানিয়েছে। নমস্কার বউদি! টুকুন ভ্যাবাচেকা খায়। বুবাই বলে — ও আমার বোন। তুমি ডাক্তারকাকুর বউমা হয়েছ জানতাম না। ডাক্তারকাকু ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিল, আসতে পারিনি। ডাক্তারবাবু থতমত— ও আমার কেউ নয়। মানে কেউ তো বটে.. মানে পেসেন্ট। লক্ষ্মীমনি কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে বুবাইয়ের দিকে। তারপর বলে ওঠে — ডাক্তারবাবু, আমার আবার খুব গরম লাগছে। শরীর আনচান করছে। আর একবার চান করব। — বলতে বলতে বাথরুমে ঢুকতে যায়। ডাক্তার সরখেল বলে ওঠেন— না না, এই বাথরুমে আর চান করতে ঢুকিস না। তুই বরং ওষুধ নিয়ে বাড়ি চলে যা। পুলিশ এলে ঝামেলায় পড়বি। হতচ্ছাড়া ন্যাপলাটা কোথায় যে পালালো! ওকে বললাম, এমিলিনাম নাইট্রোসাম...! দেখছি, আমি নিজেই দেখছি। বুবাই, টুকুন তোমরা ওপরে কাকিমার কাছে যাও। আমি একটু সামলে নিয়ে আসছি। এমন সময় বাইরে বাজখাই গলার আওয়াজ শোনা যায় — থানা থেকে আসছি। এটা কি জি ডি সরখেলের ডিসপেনসারি? ডাক্তারবাবু চমকে ওঠেন— পুলিশ! ওই যে ভেতর ঘরে সিঁড়ি। যাও যাও তোমরা দোতলায় যাও। লক্ষ্মীমনি, তুমিও ভেতরের ঘর দিয়ে ওপাশের গেট দিয়ে বাড়ি চলে যাও। ওষুধ পড়ে নেবে। পুলিশের সামনে না পড়াই ভালো। বুবাই, টুকুন ও লক্ষ্মীমনি ভেতরের ঘরে ঢুকে যায়। নেপালচন্দ্র বাইরে একটা চায়ের দোকানে বসে নজর রাখছিল, সিভিল ড্রেসের পুলিশ দু’জন কখন বেরোয়। ওরা বেরোলেই ও ঢুকবে। সব লন্ডভন্ড হয়ে আছে, গোছগাছ করতে হবে। এমন সময় ইউনিফর্ম পুরা দু’জন ষন্ডাগন্ডা পুলিশকে দরজার সামনে হুঙ্কার ছাড়তে দেখে। এবার ও সত্যিই ভয় পায়। এখন ও ভাবে, আগের দু’জন কি তাহলে পুলিশ নয়! কিন্তু পেসেন্ট বলেও তো মনে হল না! তাহলে ডাক্তারবাবুর আত্মীয় হলেও হতে পারে। বাড়ির গেট দিয়ে না ঢুকে ডিসপেনসারির গেট দিয়ে ঢুকেছে। নির্ঘাৎ এখন ডাক্তার-গিন্নী হাঁক পড়বে — নেপাল, একটু মিষ্টি এনে দে! এ কাজটা ওর খুব ভালো লাগে। প্রথমে দোকানে গিয়েই ও দুটো রাজভোগ সাঁটিয়ে দেয়। তারপর ডাক্তার গিন্নীর ফরমায়েস মতো মিষ্টি নিয়ে আসে। রাজভোগের দাম অন্য মিষ্টির সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার হিসেবটা ফেরার পথে ছকে দেয়। ওর এখন রাজভোগ খাওয়ার জন্য নোলা সকসক করে ওঠে। আজ ওইসব ঝামেলায় টিফিন-ফিপিন মাথায় উঠেছে। পেট চুইচুই করছে এখন। ও করে কী, ঘুরে বাড়ির পেছন দিকে বাড়িতে ঢোকার গেট-এ যায়। ওটা যদি খোলা পাওয়া যায় তো খুব ভালো হয়। গিয়ে দেখে গেট দিয়ে এমিলি দিদিমনি বেরোচ্ছে। ও যেন হাতে চাঁদ পায়। এমিলি দিদিমনি বেরোতেই ও স্যাট করে ঢুকে সিড়ি দিয়ে তরতর করে উঠে দোতলায়৷ যা ভেবেছে, তাই। ওই দু’জন বসে সোফায়। ডাক্তার গিন্নী চা তোয়ের করছেন। ওকে দেখে বলেন— নেপাল, এসেছিস বাবা! তোকেই ডাকতে যাচ্ছিলাম। যা দোকান থেকে একটু মিষ্টি এনে দে। বুবাই ও টুকুনের সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়। মুচকি হেসে ও বলে — আমি ভেবেছিলাম, আপনারা সিভিল ড্রেসের পুলিশ। বুবাই বলে— আমি ভেবেছিলাম, তোমার মাথার গন্ডগোল আছে, ডাক্তারকাকুর কাছে দেখাতে এসেছ। এখন দেখছি… তো তোমার ইউনিফর্ম কই? নেপালচন্দ্র বলে ওঠে — আমি পাগল নই স্যার, কমপাউন্ডার। আমার ইউনিফর্ম নেই। অ্যাপ্রন আছে। পরিনি৷ দিন কাকিমা টাকা দিন। কাকিমা টাকা বের করার আগেই টুকুন একখানা একশো-টাকার নোট বাড়িয়ে দেয় — এই নিন, মিষ্টি নিয়ে আসুন। নেপাল খপ করে টাকাটা নিয়ে বলে — সবটাই? টুকুন ওর কথার মানে বুঝতে পারে না। বুবাই বলে — হ্যাঁ, পুরো একশো টাকারই মিষ্টি নেবে। ডাক্তার-গিন্নী রান্নাঘর থেকে হাঁ হাঁ করে ওঠেন। তোমরা কেন আবার...। নেপাল ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ডাক্তার সরখেল পুলিশের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এজাহার লিখিয়ে, আজকের মতো ডিসপেনসারি বন্ধ করে উপরে উঠে এসেছেন। উনি সবে বসেছেন, এমন সময় নেপাল মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঢোকে। ওকে দেখেই ডাক্তারবাবু তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন — হতচ্ছাড়া! কোথায় সটকান দিয়েছিলিস? পুলিশ তোকে খুঁজছে। নেপাল তোতলায় — আমি তো... আমি তো কাকিমা... মানে মিষ্টি...। ওই যে ওরা এলেন! আজই তোকে ছাড়িয়ে দেবো। হতচ্ছাড়া বুড়ো মানুষটাকে পুলিশের হাতে একা ছেড়ে দিয়ে উনি মিষ্টি আনতে ছুটেছেন। ঘাড় ঘুরিয়ে গিন্নিকে বলেন — আর তোমারও বলিহারি যাই! মিষ্টি না হয় একটু পরেই আসত। ওরা আমার ঘরের ছেলেমেয়ে! আমি একা পুলিশকে সামাল দিই কী করে বল তো! ডাক্তার-গিন্নী রে রে করে ওঠেন — পুলিশও যে তোমার কাছে দেখাতে আসে, আমি জানব কী করে! ওহ! গিন্নী, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। পুলিশ দেখাতে আসেনি, দেখতে এসেছে। ডিসপেনসারিটা তছনছ করে দিয়েছে। কেন? পুলিশের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছ যে, ওরা তোমার ডিসপেনসারি তছনছ করবে? আহা! ওরা কেন করবে? এবার নেপালচন্দ্র ময়দানে নামে — বাবু! আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আমি মাসিমাকে সব বুঝিয়ে বলছি। তাই বল! এতক্ষণ বলনি কেন, সেটাই তো ভাবছি। বুবাই ও টুকুন বলে ওঠে— ডাক্তারকাকু, বুঝতে পারছি আপনি এখন খুব ঝামেলার মধ্যে আছেন। আজ বরং আমরা উঠি। অন্যদিন আসব। বস বস! ঝামেলা সব সেরে এসেছি। ডিসপেনসারি বন্ধ করে এসেছি। তোমাদের সঙ্গেই কথা বলব এখন চল, পাশের ঘরে চল। আর গিন্নী, তোমার যা সব খাওয়ানোর আছে, ওই ন্যাপলাকে দিয়ে ও ঘরে পাঠাও! পাশের ঘরে বসার পর ডা. সরখেল ডিসপেনসারির বৃত্তান্ত সংক্ষেপে ওদেরকে বলেন। ওরা সমবেদনা সূচক আহা-উহু করার পর বলে— কোর্ট থেকে ফোন করেছিলাম তো! তখন বুঝতে পারিনি যে, আপনি এত ঝামেলার মধ্যে আছেন। না না, ঠিক আছে। বললে, তোমরাও কোর্টে গিয়েছিলে! কেসটা হাও মাচ হাও ফার? ইউনিফিকেশন হওয়ার চান্স আছে। বুবাই বলে — কাকু, যা বুঝলাম, ওদের ইউনিফিকেশন করানো জজসাহেবের কর্ম নয়। হাড় ভাঙলে ডাক্তারেই প্লাস্টার-টাস্টার করে সে ভাঙা হাড় জোড়া লাগায়। এক্ষেত্রে ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগাতে হবে ডাক্তারকেই। সে আবার কী? কাউন্সেলিং করাতে হবে? সাইকায়াট্রিস্ট লাগবে? আমি কেসটা যা বুঝলাম কাকু, আপনার দ্বারাই হয়ে যাবে। কাউন্সেলিং ওরাই একে অপরকে করবে। আমাদের শুধু ক্ষেত্রটা তৈরি করে দিতে হবে। সে আবার কী? বলছি কাকু বলছি। প্রাইমারি প্ল্যানটা টুকুনের মাথা থেকেই বেরিয়েছে। আমি একটু ডেভেলপ করেছি। বাকিটা আপনাকেই অ্যারেঞ্জ করতে হবে। বুঝিয়ে বলতে একটু সময় লাগবে। তার আগে কাকিমার দেওয়া মিস্টিটিস্টিগুলো খেয়ে নিই। তা না হলে মাঝপথে ওই আপনার ন্যাপলা ঢুকে ডিসটার্ব করবে। হা হা হা, খেয়ে নাও। আমারই উচিত ছিল। আসলে...! কাকু, আসল জিনিস অনেক সময় কাজে লাগে না। কখন-সখনো নকলেরও প্রয়োজন হয়। সেটাই বলব দরজা বন্ধ করে। এমন সময় নেপাল দু’খানা কাঁসার ডিসভর্তি মিস্টি নিয়ে ঘরে ঢোকে। সেসব শেষ করতে বুবাই-টুকুন বেশি সময় নেয় না। তারপর দরজা বন্ধ করে প্ল্যান-পরিকল্পনা ফাইনাল হওয়ার পর বুবাই ও টুকুন উঠে পড়ে — আজ যাই কাকাবাবু। দেখি, বাবা-মা বাড়িতে ফিরল কি না!

ক্রমশঃ
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register