- 5
- 0
নিউ মাল কখনো পুরোনো হয় না!..
এর আগেও যতবার নিউ মাল জংশনে নেমেছি, মনে হয়েছে বাহ্ কি সুন্দর নতুন ঝকঝকে স্টেশনটা!..এলেম আবার তোমার কাছে!..
এবারও কাঞ্চনকন্যা থেকে নেমে এই সুখানুভূতি হল!.
এসেছি ঘন ঘোর বরষায়। ডুয়ার্সের বৃষ্টিকে উপভোগ করব বলে। বর্ষার ডুয়ার্স সব সময়ই অন্য মেজাজের!
নিউ মাল জংশন থেকে চেল নদীর চরে পশ্চিম ডামডিম পর্যটক আবাসে পৌঁছাতে সময় লাগে বড় জোর আধঘন্টা। পথের হিসেবে চোদ্দ কিলোমিটার।
আকাশ জুড়ে যেন মেঘবালিকারা খেলে বেড়াচ্ছে। বর্ষায় ডুয়ার্সের আকাশ দেখার আনন্দ মনকে প্রসন্ন করে দিল। গাড়ি এগিয়ে চলেছে ডামডিম মোড় ছেড়ে অলিগলির জনপদ দিয়ে। এই রাস্তাটুকু জুড়ে মানুষের ঘরবাড়ি। দোকান - বাজার। তারপরই শুরু হবে প্রকৃতির রাজত্ব!..নীল দিগন্তে সবুজ ম্যাজিক!...
নিউ মাল জংশন থেকে চোদ্দ কিমি পথ পেরিয়ে পর্যটক আবাসে পৌঁছে প্রথমেই মনে হল, এলেম নূতন দেশে!..চা বাগান, নদী, চারপাশে পাহাড়ের আবছা রেখা, হাতিদের আনাগোনা, নেকড়ের লুকোচুরি, পাখিদের ফিসফিস আর অপার সৌন্দর্যে পশ্চিম ডামডিম পর্যটক আবাস আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল!..প্রকৃতি এখানে বড় শান্ত। নিঝুম। স্নিগ্ধ সুন্দর । নিসর্গের রাজমুকুট মাথায় নিয়ে পশ্চিম ডামডিম অফবিট অপরুপ।
পশ্চিম ডামডিম পর্যটক আবাস আপালচাঁদের জঙ্গল আর চেল নদীর যুগল বন্দীতে বন্দিনী শান্ত প্রকৃতির মাঝে মন ভালো করার এক আনন্দনিকেতন।
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর এই পর্যটক আবাসের উদ্বোধন করেছিলেন। তাঁর "বিউটিফুল বেঙ্গল " এর একটা ফুল যেন পশ্চিম ডামডিম পর্যটক আবাস।
শিলিগুড়ি নিবাসী কর্মপ্রাণ সুভদ্র মানুষ তারকনাথ ভট্টাচার্য লিজ নিয়ে এই পর্যটক আবাসকে ডুয়ার্সে আসা ভ্রমণ প্রিয় মানুষদের জন্য আকর্ষণীয় এক ভ্রমণ কেন্দ্র করে তুলেছেন। তাঁর যত্নে নজরদারিতে পর্যটক আবাসটি ভ্রমণপিপাসুদের মন জয় করেছে।
১২ একর জমির ওপর ছড়ানো এই পর্যটক আবাসে পা দিয়েই মন ভালো হয়ে যায়। চোখ জুড়িয়ে যায়। চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে চারপাশের দিগন্ত বিস্তৃত চরাচরকে দেখার মজাই আলাদা। আর কোথাও ছুটে ছুটে না গিয়েও শুধু এখানে বসেই ভ্রমণকে সার্থক করে তোলা যায়।
আর মন চাইলে চলেও যাওয়া যায় হুশ করে আপালচাঁদের জঙ্গলে, মাগুরমারির বনবস্তিতে, বৈকুন্ঠপুর অরণ্যে, সরস্বতীপুরের বনে- বনান্তরে, গজলডোবার তিস্তা ব্যারাজে।
এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
পর্যটক আবাসের সুবিশাল বাগান ঘেরা আঙিনায় সুন্দর সুন্দর আটটি কটেজ রয়েছে।
প্রতিটা কটেজই একদম আধুনিক রুচিসম্মত ভাবে সাজানো। সব কটা কটেজেরই একটা করে নাম আছে- মেঘবালিকা, বনলতা, চুপকথা, কথাকলি, আকাশগঙ্গা, গাঙচিল, তৃণান্তিকা ও মাধবীলতা। আর রয়েছে এক মস্ত বড় নজরমিনার। এই ওয়াচ-টাওয়ারে উঠে দাঁড়ালে মন হারিয়ে যাবেই যাবে।
আমি ছিলাম " চুপকথা" র বাসিন্দা। বর্ষার ডুয়ার্স দেখব বলে দুরাত্রি তিনদিনের বৃষ্টি ভেজা সফরের মুসাফির। তারকদার সাথে সে কথাই হয়েছে আমার। এবার আমি শুধু বর্ষাই দেখব দিনরাত। ছুটে ছুটে বেড়াব না কোথাও।
বৃষ্টিকে সাথে নিয়েই এসেছিলাম। দু'দিন ছিলাম বৃষ্টিবাস মগ্নতায়। বৃষ্টির রুপ যতরকম ভাবে দেখা যায় দেখেছি। উপভোগ করেছি। বৃষ্টির গান শুনেছি। বৃষ্টির সাথে কথা বলেছি!..
বৃষ্টি ঝিরিঝিরি, কখনো বৃষ্টি ঝমঝম। আবার বৃষ্টি যখন নিজেই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটু বিরতি দিয়েছে, আমি তখন বেরিয়ে পড়েছি চুপকথার ঘর- বারান্দা- উঠোন ছেড়ে নদীর কাছে। চা বাগানের কাছে। পায়ে পায়ে এই একলা ভ্রমণ আমাকে রাঙিয়ে দিয়েছে, সবুজ করে দিয়েছে শহুরে মনটাকে। বৃষ্টি ভেজা পশ্চিম ডামডিম এর রুপ বড় স্নিগ্ধ। মাটির সোঁদা গন্ধ, চা বাগানের হাওয়াবাতাস আর নদীর জল ছলাৎ ছল!.. মনকে আবেশে আবেগে ঋদ্ধ করে দেয়।
"চুপকথা" র ঘরে একলা চুপ করে থাকতে চাইলেও থাকা যায় না সব সময়। পাখিদের কিচিরমিচির লেগেই আছে। হয় ওদের ঝগড়াবৃত্তান্ত শুনতে হবে নয়তো শিস দিয়ে ওরা গাইবে। সে গান শুনে মুগ্ধ হওয়ার আনন্দ। এই পর্যটক আবাসের বাগানে হরেক পাখির অবিরত আনাগোনা। ওদের ভিসা, পাসপোর্ট সব যেন তারকদার কাছে জমা রয়েছে। ওরা তাই আনন্দে উড়ে উড়ে আসছে, গাইছে, নাচছে। বনটিয়া, ময়না, ধনেশ, মাছরাঙা, নীলকন্ঠ, ঘুঘু, চড়াই, শালিকও আছে।
রাণীচেরা,বেদগুড়ি, সহেলি, কুমলাই, গুডহোপ- এগুলো সব চা বাগানের নাম। চারপাশেই ছড়ানো এই সবুজ বাগানগুলো। এ এক আশ্চর্য সুন্দর দুটি পাতা একটি কুড়ির দেশ।
সন্ধ্যার আলোছায়ায় বারান্দার নির্জনতায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দূরের আবছা আলো ঝিকমিক পাহাড়ি সব গ্রামকে দেখা যায়। কি সুন্দর সুন্দর সব নাম গ্রামগুলোর- বরবট, চুইখিম, কুমলাই। এই অচেনা পাহাড়ী গ্রামগুলোকে দেখতে দেখতে মন উদাস হয়ে যায়। মনে হয় আমি যেন এক রুপকথাপুরের বাসিন্দা। 'চুপকথা'য় আমার দু'রাত্রির বনবাস।
আমার বৃষ্টিভেজা এই ছোট্ট সফর শুধুই পশ্চিম ডামডিমকে ভালোবেসে সাজানো। এখান থেকে চাইলে পরিচিত জনপ্রিয় সব পর্যটন কেন্দ্রে চলে যাওয়া যায়। চালসা মোড় ২১ কিমি। চালসা থেকে সামসিং, রকি আইল্যান্ড, সুনতালেখোলা, কুমাই হাত বাড়ানো দূরত্বে মন ভোলানো সব জায়গা।
গরুবাথান সামান্য দূরে। সেখান থেকে ডালিমটাঁড় ফোর্ট অপরুপ সুন্দর।
বর্ষার ডুয়ার্সে নদীর রুপ, আর নদীর রুপোলি শস্য সেই সব মাছ চেখে দেখেছি এই দুদিন। বোরলি, ঝিলা, দারাঙ্গি ওদের নাম। পর্যটক আবাসের একদম গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে এক শীর্ণা নদী কালিখোলা। এই নদীর জলে জাল ফেলে মাছ ধরার মজা নিজের চোখে দেখাও একটা আনন্দ।
হাতির করিডর এটা। আপালচাঁদের জঙ্গল থেকে হাতি বেরিয়ে এসে প্রায়ই চলে যায় এপথ দিয়ে। তাই পর্যটক আবাসের চারধারে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে ঘিরে রাখা। চা বাগানে লেপার্ড আসা যাওয়া করে। তাই রাতের অন্ধকারে নিরাপদে চলতে হয় পর্যটক আবাসের মধ্যেও।
বনবাসের এই রোমাঞ্চগুলো পশ্চিম ডামডিমে এলে পাওয়া যায়। তাই পশ্চিম ডামডিমে ফিরে ফিরে আসতে ভালো লাগে।
বৃষ্টিকে সাথে করেই এসেছিলাম, ফিরেও যাচ্ছি বৃষ্টিকে নিয়ে। আজ সন্ধ্যায় নিউ মাল থেকেই কাঞ্চনকন্যায় উঠব। গাড়ির ঝাপসা কাঁচে বৃষ্টির জলছবি। চা বাগানের পাশ দিয়ে গাড়ি ছুটছে। জলভরা কালো মেঘে আকাশ সেজে আছে। একটু পরেই ডামডিম মোড়। সেখান থেকে নিউ মাল জংশন সামান্য রাস্তা।
মন রাঙানো এই বৃষ্টি ভেজা জল সফরে মুসাফির মন সবুজে সবুজ হয়ে আছে।
কিভাবে যাবেন -
শিয়ালদহ থেকে রাতের কাঞ্চনকন্যায় পরের দিন সকালে নিউ মাল জংশন।
নিউ মাল থেকে ডামডিম মোড় হয়ে পশ্চিম ডামডিম পর্যটক আবাস ১৪ কিমি পথ।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। খুব সহজেই স্টেশন থেকে পৌঁছে যাওয়া যায়।
থাকার জন্য একমাত্র অদ্বিতীয় এই পর্যটক আবাস। তারকনাথ ভট্টাচার্যর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবেন।
এই নাম্বারে কথা বলবেন - ৯৪৩৪০৪৯১৮০ / ৯৮৩২৫৯৮০৪২
।। সমাপ্ত।।
0 Comments.