Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

প্রবন্ধে তনিমা হাজরা

maro news
প্রবন্ধে তনিমা হাজরা

আমার নিজের ধর্ম

ধর্ম শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় এর উৎস ধৃ ধাতু থেকে। ধর্ম= ধৃ+মন। ধৃ মানে ধারণ করা আর মন অর্থাৎ অন্তরাত্মা রা অন্তর। সুতরাং আমরা অন্তর দিয়ে যা ধারণ করি তাই আমাদের ধর্ম।
তাহলে এটাই দাঁড়ালো যে ধর্ম কোনো বংশপরম্পরায় বহন করে চলা মতবাদ বা আচরণ হতে পারে না। এমনকি একই পরিবারে বিভিন্ন মানুষের ধর্ম বিভিন্ন হতে পারে যদি তাকে তার নিজস্ব ধারণ ক্ষমতা বা ধারণা কে অভ্যাস করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়। আর এটাও স্পষ্ট যে ধর্মের সাথে কোনো ধূপ,দীপ,ফুল, চাদর, আতর, মোমবাতি, ফল ইত্যাদির কোনো সম্পর্কই নেই।
ধর্ম নেহাতই মানুষের যাপন সংজাত এক দার্শনিক বোধ বা অনুভূতি যা একজন মানুষের নিজস্ব ভাবনা বা অন্তর্ভুক্ত উপলব্ধির ছায়া, বাঁচার জন্য বেছে নেওয়া নিভৃত আশ্রয়ের প্রতিফলন মাত্র।
যদি সম্যক জেনে ধর্মবিষয় নিয়ে ধারণা লাভ করতে পারি তাহলে সহজ কথায় এটাই সবার জানা উচিত যে ধর্ম প্রত্যেকের স্বতন্ত্র  ব্যক্তিগত নিজেকে দেখার আয়না।
কিন্তু এভাবে ধর্মকে আমরা ক'জন ভাবি বা ব্যাখ্যা করি। আমাদের অধিকাংশেরই কাছে ধর্ম হচ্ছে বংশপরম্পরায় শেখানো কিছু প্রতিকৃতি বা আচরণের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং সমর্পণের তোতাপাখির শিক্ষা। যা আমরা না বুঝে, না বিচার করে, না গভীরে যাবার চেষ্টা করেই পালন, যাপন এবং বিস্তার করে আত্মপ্রসাদ লাভ করি। এই কলুর বলদের মতো অভ্যাস আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তা, স্বতন্ত্র বোধ কে দিনগত সংস্কারের গন্ডিতে ঘুরিয়ে মারে রাখে আর নিজস্ব বোধের পথে হাঁটতে দেয় না। এর বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য যে আলোকিত চিন্তার  দরকার কিছু অভ্যাসজনিত ভয় আর কুসংস্কার তাকে শিকলে বেঁধে রাখে। সেই বিভ্রম, সেই গন্ডি,সেই বেড়ি,সেই চিন্তনহীন আচার আমাদের সংস্কারগত বৃত্তাকার পথে ঘুরিয়ে মারে বলেই আমরা বংশগত ধর্মের দাসত্ব করে নিজেদের ধার্মিক প্রমাণ করার ব্যর্থতায় নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠি। তখন ধারণের চেয়ে উপাচার, সহিষ্ণুতার চেয়ে হানাহানি এবং ভালবাসার চেয়ে বিদ্বেষ  প্রধান হয়ে ওঠে।
অবুঝ মানুষকে নিয়ে স্বার্থের পাশা চালে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ। কোনো সহজ বস্তুকে জটিল আকার দিয়ে ঘোলাটে করে ফেলার খেলার নামই প্রভুত্ব।
এইজন্য কোনো বিশেষ ধর্মের স্থাপনার পিছনে কোনো অলৌকিক ঈশ্বরের অবদান নেই, আছে গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রসারণ। মানুষের অন্তর্নিহিত অস্তিত্ব সংকট, লোভ,কামনা, মোহ এইসবই ধর্ম সৃষ্টির মূল। যখন আমাদের সবকিছু হারিয়ে গেছে তখন কাজ করে অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার ভয়, যখন আমাদের বিশেষ কিছু পাবার ইচ্ছে  তখন কাজ করে চাওয়া পাওয়ার বাসনা আর কামনা, আবার যখন আমাদের কাছে অনেক কিছু আছে তখন কাজ করে হারাবার ভয়। এইসব কিছু টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা একজন শক্তিমান সত্ত্বাকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে চাই, এই শক্তিমান সত্ত্বাই আমাদের চোখে এক এক ধর্মের এক একজন ঈশ্বর। যার কাছে আমরা মনের ইচ্ছে, লোভ, ক্ষোভ, অভিযোগ বাসনা জানিয়ে শান্তি পাই,তৃপ্তি পাই, আমরা যেমন ভাবে ভাবতে চাই, যেমন ভাবে ইচ্ছার কাঠামো বানাতে চাই সেই ঈশ্বর তার প্রতিবাদ করেন না। এইসব আন্তরিক বাসনা থেকেই আমরা আমাদের স্বনির্বাচিত ঈশ্বরের দাসত্ব করি।তাকে ফুল,ফল, টাকা, গহনা উপঢৌকন দিয়ে নিজস্ব বাসনা আদায়ের চেষ্টায় জপে যাই, ভজে যাই। সেই অভ্যাস থেকে মোহ ও মোক্ষ জনিত স্তব, প্রার্থনা, গান রচনা করে তাঁকে তুষ্ট করে নিজস্ব কাজ হাসিল করার লালসায় উন্মত্ত হয়ে উঠি।
কিন্তু একবারও আত্মানুসন্ধান করে নিজস্ব সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে প্রকৃত জ্ঞানের সাগরে ডুব দেবার কথা ভাবি না, যে সন্ধানের কোনো গন্ডি নেই, সীমা নেই, নির্দিষ্ট নামাঙ্কিত দেবতা নেই। যেখানে সব সন্ধান একাকার হয়ে সীমাহীন হয়ে গেছে।
নিজেকে অনুসন্ধানের নিমিত্ত যে ধর্মাচরণ তা সতত নিভৃত,  নীরব এবং প্রচারবিমুখ। সেখানে অন্যের প্রতি বিভেদ বা বিদ্বেষের কোনো স্থানই নেই। তা প্রতিটি মানুষের একান্ত আত্মগত আলো হাতে ব্যক্তিগত খোঁজ।
সেখানে আলাদা কোনো ঈশ্বর নেই। প্রতিটি মানুষ তখন নিজেই নিজের ঈশ্বর ।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register