Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে কিশোর ঘোষ (পর্ব - ৪)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে কিশোর ঘোষ (পর্ব - ৪)

মুহূর্তের সেলফি

সেগমেন্ট ৪

মুহূর্তের সেলফি হাজার বিষয়ে বাঁক নিলেও এতদিন মূলত শিলিগুড়িতেই ছিল। কিন্তু মুহূর্তের যেহেতু স্থান-কাল হয় না, অতএব আজ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে যেতে ইচ্ছে করছে খুব। তাঁকে নিয়ে কিছু সত্যি, কিছু স্মৃতি বললে মন্দ হয় না। আজ সত্যিটা বলব, পরের রবিবার যাব স্মৃতিতে।
আসলে সুযোগ পেয়ে সংক্ষিপ্ত গুরুদক্ষিণা লিখতে চাইছি আমি। যেহেতু গতকাল অর্থাৎ ৭ সেপ্টেম্বর ছিল বাংলা ভাষার অন্যতম অহঙ্কার কবি ও গদ্যশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। এক্ষেত্রে ফেসবুক আমাকে সাহায্য করেছে। মনে রাখতে হবে, ফেসবুকের অনেক খারাপ দিকের মধ্যে একটি ভালো দিক হল, সে মনে করিয়ে দেয় আজ কোন দিবস কিংবা আজ কোন কৃতির জন্মদিন বা মৃত্যদিন ইত্যাদি। এবং সেই মতো পোস্টের বন্যা বয়ে যায় অন্তর্জালে। যথারীতি অধিকাংশই হয় অন্তসারশূন্য অথবা হাস্যকর। অনেকে আবার এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রচ্ছন 'রাজনীতি'তে মাতেন। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কালো দিকে যেতে চাইছি না। আমার মনে পড়ছে টুকরো ফ্ল্যাশব্যাক।
যেমন, নয়ের দশকে আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম সুনীল তখন বাংলা সাহিত্যের দেবদূত। দশহাতে লিখছেন। ভাবছেন ও ভাবাচ্ছেন। দেশ-কাল-সমাজ-সভ্যতা-জন্ম-মৃত্যু-প্রেম-যৌনতা নিয়ে মতামত দিচ্ছেন নিজের মতো করে। আর শিক্ষিত সাধারণ বাঙলির অধিকাংশ তাঁর ভাবনায় ভাবিত হচ্ছে। সবটা যে মেনে নিতে পারছে তা না, কারণ ভিতু মধ্যবিত্তের অতটাও কলজের জোর নেই। তাছাড়া স্বভাবে হোক বা ভাগ্যদোষে বউ-বাচ্চার মায়া জড়ানো দশটা-পাঁচটার জীবন থেকে মুক্তি নেই বেচারাদের! হয়তো অবচেতনে তাঁরাও অনুভব করেন---জীবনকে 'নীললোহিত' যতটা ছুঁতে পারল আমরা তা পারলাম না! মধ্যবিত্তের না পারার এই বেদনাই হয়তো সুনীল-সাহিত্যের বিপুল জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। কতকটা একই কারণে বাংলাদেশ জয় করে কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদ। শুধু সুনীল আর হুমায়ূনের কথাই বা বলছি কেন, পৃথিবীর ইতিহাসের সমস্ত শ্রেষ্ঠ শিল্পীই তো স্বপ্নের ফেরিওলা ছাড়া কিছু না। সারাদিন চাকরের জীবন কাটানোর পর দিনান্তে গান শুনতে শুনতে, সিনেমা দেখতে দেখতে কিংবা কবিতা পড়তে পড়তে নিজেকে মালিক তথা কল্পিত রাজা অনুভব করাই তো পাঠকসত্ত্বা। এর মধ্যে অবশ্য আমার মতো 'এলিয়েন' পাবলিককে পাবেন না।
আমার প্রথম সুবিধা হল আমি ঘোষিত অশিক্ষিত, তদুপরি অবাধ্য। পরিবার-পাড়া-রাজ্য-দেশ-কাল-সমাজ-সভ্যতার কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়েছি অন্য কান দিয়ে...। তার উপর সন্দেহ বাতিক। যেমন, বাড়িতে ঘটা করে সরস্বতী পুজো, আর খামোকা ঘ্যানঘ্যান তুললাম---ঠাকুর মশায় যে মন্ত্র আওড়াচ্ছেন তার অর্থ কী? পুরোহিত কি জানেন? জানলে বলুন। না জানলে তিনি কিসের অধিকারে পুজো করেন? এদিকে স্কুলের পরীক্ষায় কিন্তু লবডঙ্কা ছাত্র। অতএব, আমার কথা শুনেই রে-রে করে উঠল জ্যাঠা-কাকারা। একি অলুক্ষুণে কথা! আমার মুখ চেপে ধরল সবাই। এবং আমিও একটু একটু করে বুঝতে শিখলাম, যে গ্রহের যে আবহে বেঁচে আছে এই মানুষ সেখানে সত্যি বলার নিয়ম নেই। বরং রুটিন মিথ্যে বলাই বুদ্ধিমানের কাজ। যেমন ধরুন, রাস্তাঘাটে আত্মীয় পরিচিতদের দেখা মাত্র 'ভালো আছেন?', 'কেমন আছেন?' বলিনি বলে বাড়িতে বকা খেতে হয়েছে আমায়। কিংবা সঙ্কীর্ণ মানসিকতার বড়কে প্রণাম করিনি বলে বাড়িতে অশান্তি। প্রশ্ন তুলছিলাম, যাঁকে প্রণাম করব তিনি কি প্রণম্য?
সব মিলিয়ে আমার বড় হওয়া আসলে এক অবাধ্যতার বড় হওয়া। ওই অল্প বয়সেই একটা বিষয় পরিষ্কার হচ্ছিল---একদিকে জঙ-ধরা সমাজের মগজধোলাই অন্যদিকে উদার মহাবিশ্বপ্রকৃতি। এই দুইয়ের মাঝে নিজের জীবনটাকে খুঁজে পেতে হবে। সোজা কাজ না, বরং এলডোরাডো সন্ধানের মতোই কঠিন। কিন্তু একটা ম্যাপ তো লাগবে, যেহেতু এক অপার্থিব গুপ্তধনের উদ্দেশ্যে মেতে উঠেছি। এও জানি যে, গোটা মানচিত্র মিলবে না। টুকরোটাকরা ছড়িয়ে থাকাবে পথে-ঘাট-উঠোনে। দমকা হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার আগেই কুরিয়ে নিতে হবে সেসব। সেই মতো লুকিয়ে লুকিয়ে আমি সুনীল পড়তে শুরু করলাম।
বুকের ভেতরে একটা খাচকাটা তাক, সেখানে জড়ো হতে শুরু করল ফুটবল-ঘাস-নীরা-নীললোহিত-নক্ষত্র-ভালোবাসা নাও হারিয়ে যেও না-বিকেলের সাইকেল-অরণ্যের দিনরাত্রি-কাঠালতলার আড্ডা-ছবির দেশে, কবিতার দেশে-ক্যারাম-প্রথম আলো-পিকনিক-শ্রেষ্ঠ কবিতা....। এভাবে বলতে থাকলে দিন কাবার হয়ে যাবে। আসল কথা হল, এসবই মহাশূন্য জোড়া দিতে দিতে একটা মহাকাশ স্টেশন গড়ে তোলার ছক। যা আমাকে সেই গুপ্তধনে পৌঁছে দিতেও পারে আবার নাও পারে। তবু সেই না পারাটুকুও যে পারা তা কে শেখালো? এই জীবন দর্শনের মধ্যে যে সাহস, তা কে যোগালো? কবিতা নিয়ে, কবিকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য টের পেতে শুরু করা আমি অপমান উপেক্ষা করতে শিখলাম কীভাবে?
শিখলাম কারণ ততদিনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পড়তে শুরু করেছি। যার হাতকাটা বুশ শার্ট, মাস্তানের মতো বুকের বোতাম খোলা, দরাজ হাসি, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আর লেখার টেবিল। মাথা-নীচু নিরলস অধ্যাবসয়। সেই মানুষটাই আবার বেরিয়ে পড়ে মধ্যরাতের কলকাতার অলিগলিতে। কিংবা চাইবাসা কী উত্তরবঙ্গের জঙ্গলের মাথার চাঁদ খুঁজতে ছুট দেয়। নীরা নীরা নীরা চিৎকার দিয়ে কাঁপিয়ে দেয় ত্রিভূবন! এবং যিনি সদর্পে বলতে পারেন, কবিতা সবার জন্য না। এ কথার মধ্যে যেমন ছিল চূড়ান্ত সত্যি, তেমনি ছিল কবিতার প্রতি গভীরতম সম্ভ্রম। যা শোনার পর তরুণ কবি হিসেবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠাই তো স্বাভাবিক।
অতএব, বুঝে উঠছিলাম---ঠিক পথেই এগোচ্ছি। সমাজ শাসাবে, সভ্যতা মারবে, তবু থামলে চলবে না।
সুনীল পড়তে পড়তে... জীবন যে সমুদ্র, তার যে সীমা পরিসীমা হয় না তা টের পাচ্ছিলাম আমিও। আর এক বিস্তারের আনন্দে মেতে উঠছিল আয়ু। সেই বিস্তার আসলে এক সত্যি। সুনীলের মতোই বড় ও মহাজীবনের সত্যি।
[অনিবার্য কারণ বশত লেখকদের তরফ থেকে লেখা না পাওয়ায়,ধারাবাহিকটা সম্পূর্ণ প্রকাশ করা সম্ভব হল না!]      
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register