Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

ক্যাফে গল্পে প্রভাস দাস

maro news
ক্যাফে গল্পে প্রভাস দাস

বৃষ্টি তখনও থামেনি

এমন দিন আর ফিরে আসবে না কখনো। উজ্জ্বল আশমান আর রাশি রাশি নক্ষত্র ভরপুর আলিঙ্গনে ছুটছে পরস্পরে। যদিও এই শোভা বেশী ক্ষণের জন্য নয়। দেখতে দেখতে শীতল বাতাস কোথা দিয়ে ছুটে এসে বারি ধারা হয়ে ঝরে পড়ল সর্বাঙ্গে। মুহূর্তের জন্য সব কিছু বিসর্জন দিয়ে মুঠো ভরা জল নিয়ে মেখে নিল নিজের মুখে বুকে। ‘মা ভেতর থেকে উচ্চ স্বরে ব’লে উঠল, ‘ওরে তুই কি ছোট্ট খুকি হয়ে গেছিস, এই রাত্রির বেলায় ভিজছিস।’ মেঘা নিজের চুলের গোছা খুলে দিয়ে ভেজা বুলবুলির মতন পাখসাট দিয়ে বলল, ‘নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না গো মা।’ ‘ঠাণ্ডা লাগালে কি হবে বল, এরকম ছেলেমানুষী করলে হবে?’ ‘এই আসছি গো মা’। আকাশে নিশানাথ দেখা দিলে মেঘা ছুটে গিয়ে মুঠোফোনে কটা ছবি তুলে নিল। “ঝিরঝির বারিধারা নিশানাথ আসমান নয়নে জমানো ধুলো ঝেড়ে নাও হে প্রাণ গোপনে সঞ্চিত বুনো ফুলের মালা নিও যবনিকা কুঞ্চিত, ঘন মনের গান শুনিও।” মেঘা আরও কয়েকটি ছবি তুলে গুনগুন করতে করতে ভিতরে চলে গেল। পর দিন সকাল। টগবগে রোদ উঠেছে। টবের গাছ থেকে কিছু ফুল, জবা, জুঁই, আকন্দ সংগ্রহ করছে ঈশ্বরের চরণে অর্পণ করবে বলে। তখনই পাশের বাড়ি ভ্রান্তি ভিলার দ্বিতীয় তলার জানলার ভিতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ছোট্ট রণিত। মাসিমণি মাসিমণি করে মেঘাকে ডাকছে। তাঁর মা শঙ্কিতা পাশেই কিচেনে। পেশায় অ্যাডভোকেট, এবং ডাক্তার অমিত রায়ে'র বউ হয়েও নিজের সন্তানের ব্রেকফাস্ট তৈরি করবার জন্য চাকর বাকরদের সাহায্য নেয় না। মেঘা মাঝে মধ্যেই ডঃ অমিতে'র চেম্বারে যায় এবং প্রতিবেশী হওয়ার কারণে ভালো আলাপও রয়েছে তাঁদের দুজনের মধ্যে। মেঘার প্রায় রুটিন চেক আপে যেতে হয় ডঃ আমিতের কাছে কারণ তাঁর অ্যারথারাইটিস আছে এবং যার ফলে স্বাভাবিক জীবন যাপনে কিঞ্চিত অসুবিধা পোহাতে হয় অনেকের চেয়ে। মেঘা রণিতের দিকে হাত নাড়িয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার রণিত বাবু কী করা হচ্ছে?’ রণিত কাঁদতে কাঁদতে বলে ‘দ্যাখোনা মাসিমণি মামনি বকেছে, তুমি মাম’নীকে একটু বকে দেবে?’ ‘হ্যাঁ কেন নয়। ভারি অন্যায় হয়েছে যে আমাদের রণিত বাবুর সাথে।’ ‘তুমি তাহলে সত্যি সত্যিই বকবে, মামনী যদি তোমাকেও বকে দেয় তুমিও কি আমার মত কষ্ট পাবে?’ শঙ্কিতা ঘরে প্রবেশ করল রণিতের জন্য ব্রেকফাস্ট নিয়ে। মেঘাকে ওই অবস্থায় রণিতের সাথে কথা বলতে দেখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কী ব্যাপার নালিশ করা হচ্ছে মানির কাছে মায়ের নামে?’ ‘ আমি মানিকে বলেছি তোমার জন্য আরেকটা ভালো রণিত এনে দিতে। এই রণিত ভালো নয় এই রণিত রটেন।’ ছেলের অভিমান দেখে শঙ্কিতার চোখ ছলছল করে উঠল ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে চাপা স্বরে বলল,‘ এই যে, আমার রণিত বাবুর অভিমান হয়েছে। আমার অন্য কোনো ভালো রণিতের দরকার নেই, আমার এই রটেন রণিতই ভালো।’ মেঘা শঙ্কিতার কাছে অনুমতি নিয়ে ভিতরে চলে এল। মা ছেলের অভিমান দূর আকাশের বুকে রিক্ত সূর্য রোদের কণায় কণায় হাসি ও কান্নার রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে মনের গভীরে, জীবনের গানে। একদিন হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে প্রবেশ করল মেঘা। সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে তাঁর মা'। ব্যথা পেয়েছেন তবে বেশি কিছু নয়। অমিত বলেছেন দুই সপ্তাহ বেড রেস্ট নিতে। গোড়ালিতে ব্যান্ডেজ, ভালো মতো হাটতে পারছেন না। মেঘা চা করে নিয়ে আসতে গেল অমিতের জন্য। অমিতের অবজারভেশন শেষ হয়েছে। মেঘা রিকোয়েস্ট করায় অমিত রাজি হল চা খেতে। কিন্তু সাথে সাথে সংশয় গ্রস্ত হলো ভেবে যে ‘শঙ্কিতা যদি জানতে পারে ! সে যে মেঘার হাতে চা খেতে বারণ করেছিল! তবুও নিজেকে আটকে রাখতে পারল না অমিত। এমন কাঙ্ক্ষিত পানীয় লাবণ্যময়ী মেয়ের হাতে এমন সময়। সে মনে মনে এই বোধ হয় এরই অপেক্ষায় ছিল! কয়েকটী নাড়ু ও সুদৃশ্য পেয়ালায় চা অমিতের হাতে এসে পড়াতে, সুবোধ শিশুর মত খাওয়া শেষ করে মেঘার মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে উঠে দাঁড়ায় অমিত। এবার বোধ হয় শারদোৎসব মেঘের দোলায় চড়বে। সকাল থেকে বৃষ্টি যেন কোনো রূপবতীকে তাঁর রূপের সোনালী আভায় জগত সংসারকে শীতল রাখার কাজ জুটিয়ে দিয়েছে। আজ এই দশমীর সকালে মায়ের দেওয়া শাড়িটা পরে তাকেও যেন সাক্ষাত মা দুর্গার মতন লাগছে। মেঘার জীবনের সংরাগ যে কী তীব্র তা সে ঘুণাক্ষরে কাউকে বুঝতে দেয় না। তবে এ যুগের দুর্গারা বোধ হয় এমনই। একটু দূরে উঁচু মঞ্চ।তার ওপর দাঁড়িয়ে অমিত। আড় চোখে মেঘা দেখে নিল অমিত কে। পূজা মণ্ডপ জুড়ে বিরাট ছাউনি ।মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হওয়াতে ছন্নছাড়া অবস্হা।মুহূর্তে চারপাশ ভরে উঠল জলে।যেদিকে দু চোখ যায় শুধু জল। অমিত মঞ্চ থেকে মেঘার দিকে তাকিয়ে আছে।দু জনের চোখাচোখি হতেই উঠে পড়ার ইঙ্গিত দি’ল। প্রথমে একটু সংকোচ হলেও বরণের ডালা হাতে নিয়ে মঞ্চে উঠে পড়ল মেঘা। অমিত তখনও মাইকে আবেদন করে চলেছে এলাকাবাসীর কাছে। মেঘা'র প্রতিমা বরণ প্রদান শেষ হয়েছে। সে অপেক্ষা করছে শঙ্কিতা'র জন্য। পুরোহিতের বিরামহীন মন্ত্র কানে ভাসছে। অমিত মেঘা'র থেকে কিছুতেই চোখ সরাতে পারছে না, এই কি মেঘা না কোন ঐশ্বরিক দেবী। অমিত আলতো করে মেঘা'র হাতটা ছুঁতে, মেঘার বুঝতে বাকি রইলো না যে সে স্পর্শ কোন স্বাভাবিক স্পর্শ নয়। এতে আছে অন্য এক অনুভূতি মনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা অপরাধীর স্পর্ধা। এতে আছে আস্কারা মিশ্রিত এক রঙীন নেশা। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল অমিত। মেঘা অমিত কে কিছু বলতে না দিয়ে তাঁর হাতটা টেনে নিয়ে পাশের সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবে তখনই মন্ডপে আসে শঙ্কিতা। তাঁর ওকালতি দৃষ্টি কিছুতেই এড়ান গেলো না। শঙ্কিতা তাদের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে বলে উঠলো, বাহ! কি করে পারলে তোমরা, এভাবে এত কাছাকাছি হতে! কোন উত্তর দেয় না অমিত। মেঘা পাশের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে গেল। বৃষ্টি তখনও থামেনি। মেঘা ছুটে গিয়ে ছাঁদে উঠে সেই দোলাতে বসে পড়ল। ব্যতিক্রম শুধু আগের দিনের মত শরীরে শক্তির চিহ্ন মাত্র নেই, ভাব নেই, গান নেই। ঝিরঝির বারিধারা তাঁর মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। সে তো এমনটা কখনোই আশা করে নি অমিতের থেকে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register