- 3
- 0
এ সময় তো বাবার ফেরার কথা নয়। শরীর খারাপ - টারাপ কিছু হলো না তো ? সে উদ্বিগ্ন হয়ে বাবার কাছে এগিয়ে যায়। বাবার চোখে - মুখে তখন হতাশা আর ক্লান্তির ছাপ। সে জলে গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। একটু স্থিতু হয়ে বাবা যা বলে তাতে দুচিন্তা বেড়ে যায় তার।জ্ঞান হওয়া থেকেই অঞ্জলি দেখে আসছে বাবা-মা পরাণকাকাদের বাড়িতেই ঠিকে মুনিশের কাজ করেছে। ধান পোঁতা কিম্বা কাটার মরসুমে যখন মজুরের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে মজুরী বাড়ে তখনও বাবা-মা'কে সেই সারা বছরের বাঁধা মজুরীতেই কাজ করতে হয়েছে। ঘটনা এমনও ঘটেছে, নিজেদের কাজ না থাকলেও বাবা- মা ' কে অন্যের কাছে ভাড়া পর্যন্ত খাটিয়েছেন পরানকাকুরা। অন্যের কাছে থেকে অনেক বেশি মজুরী আদায় করেছেন। কিন্তু বাবা-মা'কে দিয়েছেন সেই বাঁধা মজুরী। আসলে বাবা-মা'র শ্রম নিয়েও ব্যবসা করেছেন ওরা। বিনিময়ে বাবাকে কিষাণি ভাগে যৎসামান্য জমি চাষ করতে দিয়েছেন। তাও ছিল বাবা- মা'কে আটকে রাখার একটা ছল মাত্র। ওদের নানা কায়দাবাজির জন্য অধিকাংশ বছরই বাবা নিজের ভাগে তেমন কিছু পেত না বললেই চলে। মাঝখান থেকে চাষ করার জন্য নেওয়া খাদের ধানের ঋণ ঘাড়ে চেপেই থাকত।
যখন কাজে জবাব দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখনই খাতের ধান শোধ করার জন্য চাপ দিয়েছে পরাণকাকুরা। তাই বছরের পর বছর ক্রীতদাসের মতো আধা মজুরিতেই ডবল পরিশ্রম করতে হয়েছে বাবা - মা'কে। সেই পরাণকাকুই সাফ জানিয়ে দিয়েছে , বাবাকে নাকি আর কাজে রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু কেন সম্ভব নয় তা অবশ্য ভেঙে কিছু বলেন নি। তবে পিছন থেকে কলকাঠিটা যে সুহাসবাবুরাই নাড়ছেন তা ভালোই বুঝতে পারে অঞ্জলি।কারণ সেদিন শুধু পরাণকাকার কাছেই নয় , তারপর বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন জমিমালিকের কাছে একই কথা শুনে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে বাবাকে। ওই পরিস্থিতিতে বাবাকে দেখে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল।একটা মানুষর আর কত চাপ নিতে পারে।একে তো ওই অবস্থা ,তার উপরে বাড়ি নিয়ে ও শুরু হয়েছে দুঃচিন্তা।এরই মাঝে একদিন হোপনকাকা এসে বলে গিয়েছে , সনাতনের কাছে বাড়ির কাগজপত্র জমা দিতে হবে। নাহলে একমাসের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। হোপনকাকার মুখে কথাটা শুনে অবাক হয়ে যায় অঞ্জলি।
মানুষ কত দ্রুত বদলে যায়। এই হোপনকাকাই একদিন তাদের বাড়িতে বসে সনাতনের সাতগুষ্টি উদ্ধার করেছে। ফন্দিফিকির বের করে ওকে শায়েস্তা করার জন্য ঝুলোঝুলি করেছে। বাবা নানা অজুহাতে এড়িয়ে গিয়েছেন। সেই হোপনকাকা আজ কত সহজেই সনাতনের কথা শুনে তাদের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে দিয়ে গেল।হোপনকাকা চলে যাওয়ার পরই বাবা নিজের মনেই বলে ওঠে, আর এখানে থাকতে দেবে না দেখছি। বাবার কন্ঠস্বরেই অঞ্জলি বিষাদের আভাস পায়। বাবার কাছটিতে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে। পরম মমতায় বাবার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে , তাহলে এখন কি করবে বাবা ? ---- ভাবছি বর্ধমান চলে যাব। পরাণমোড়লের বাড়িতে ঠিকে মুনিশের কাজে লাগার আগে তো খাটতে যেতাম।অনেকে আমার কাজ পচ্ছন্দ করত। বরাবর থেকে যেত বলত। দেখি তাদেরকেই কাউকে গিয়ে ধরব। তারপর একটা ব্যবস্থা হলেই তোদেরকে নিয়ে চলে যাবে। ততদিন তোরা একটু চালিয়ে নিতে পারবি না ? বাবার কথা শুনে খুব দমে যায় অঞ্জলি। মায়ের ওই অবস্থা, গাঁয়ের এই পরিস্থিতি, মাথার উপরে একজন পুরুষ মানুষ না থাকলে সে একা সবদিক সামাল দেবে কি করে ভেবে পায় না। তাই চট করে বাবার কথার কিছু জবাবও দিতে পারে না।পরক্ষণেই ভাবে , এছাড়া উপায়ও তো কিছু নেই। বাড়িতে যা জিনিসপত্র আছে মেরে কেটে দিন দশেক চলতে পারে। তারপর কাজ না জুটলে তো সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে। তার উপরে রয়েছে বাড়ি ছাড়ার দুঃশ্চিন্তাও। প্রয়োজনে সে নিজেও পড়া ছেড়ে কাজ করতে শুরু করতে পারে। কিন্তু তাকেই যে কাজ দেবে তারও নিশ্চয়তা কোথাই ? আর বাবাকে না দিয়ে যারা তাকে কাজ দেবে তাদের মতলব খুব সুবিধার হবে বলে মনে হয় না তার।কথাটা পাড়তেই বাবাও সেই একই কথা বলে। তার দোটানা ভাব দেখে বাবা বলে , দিন সাতেক কোন রকমে কাটাতে পারবি না ? তার মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হয়ে যাবে।অগত্যা মত দিতে হয় অঞ্জলিকে।
0 Comments.