Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

ক্যাফে ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব - ৪৭)

maro news
ক্যাফে ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব - ৪৭)

কু ঝিক ঝিক দিন 

ইতিহাস ফিসফিস কথা কয়,ইতিহাস প্রতিশোধ নেয়, আবার ইতিহাসই অতীত খুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়ায় যখন তখন হয়তো আমাদের অস্তিত্বটাই টলে যায়। প্রতিটি জন্ম মৃত্যু, প্রতিটি দিন ইতিহাস তার নিজের ছন্দে আশেপাশে যা ঘটছে সব লিখে রাখে। "অবশেষে সব কাজ সেরে আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে করে যাব আশীর্বাদ, তারপর হব ইতিহাস।" সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কবিতার শেষের চার লাইন বাবার কাছে বুঝতে গেছিল নবম শ্রেণীর মেয়েটি।তার বাবা বিশ্ব বিখ্যাত পন্ডিত হলেও সচরাচর তারা তিনবোনের কেউই বাবার কাছে পড়ত না।কারণ একটাই। বাবা কখনোই বিষয় ধরে পড়াতেন না।বিশেষ করে পাঠ্য বইয়ে কি লেখা আছে, কতটা পড়ানো হবে এসব নিয়ে তাঁর বিন্দু মাত্র মাথাব্যথা ছিল না। একটি কবিতা বা গল্প কিংবা ইতিহাসের কোনও নির্দিষ্ট বিষয় পড়াতে গেলে তিনি কখনোই বইয়ের লেখা পড়াতেন না।ধরা যাক - তাজমহল নিয়ে কিছু পড়াতে হবে।সেখানে তিনি প্রথমেই শুরু করলেন- "এ কথা জানিতে তুমি, ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান,/কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান।/শুধু তব অন্তরবেদনা /চিরন্তন হয়ে থাক্‌ সম্রাটের ছিল এ সাধনা।/রাজশক্তি বজ্র সুকঠিন/সন্ধ্যারক্তরাগসম তন্দ্রাতলে হয় হোক লয়য়/কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস নিত্য-উচ্ছ্বসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ/ এই তব মনে ছিল আশ। হীরা মুক্তামানিক্যের ঘটা/যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা/যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক,/শুধু থাক্‌/একবিন্দু নয়নের জল/কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল/এ তাজমহল।" এরপর রেফারেন্স হিসেবে এল তাজমহল নিয়ে লেখা বইয়ের তালিকা।ততক্ষণে তাজমহল নিয়ে পড়া ভুলে গেছে মেয়েটি।কারণ কেন সে তাজমহল পড়তে এসেছিল আর পরীক্ষার প্রয়োজনে হাফ পাতার একটা টেক্সট। এখন তার মাথায় কবিতা থেকে শুরু করে গবেষণা পেপারের সমতুল্য একটা বিষয় হয়ে গেছে। তাই হাতে অঢেল সময়,বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সময় বোর হলে,কিংবা ঐতিহাসিক স্থানের বৃত্তান্ত শোনা ছাড়া সচরাচর তারা কখনোই ' বাবার কাছে পড়ব"- এই ঐতিহাসিক ভুলটা করত না। কিন্তু সেদিন গতানুগতিক পড়া পড়তে ভালো লাগছিল না।তাছাড়া কদিন আগেই ভোরাই কবিতা বোঝাতে গিয়ে বাবা যেসব রেফারেন্স দিয়েছিলেন, সেসব লেখায় বাংলায় শিক্ষিকা সুরভীদি দারুণ প্রশংসা করেছিলেন।তাই আজ ছাড়পত্র কবিতাটা বুঝতে এসেছিল সে।কিন্তু আজ তার হাতে সময় কম।আজ ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা। অথচ বাবা কিছুতেই মূল বিষয় বোঝাবেন না। বাবা সিগারেট ধরাতেই বেরিয়ে এল বই নিয়ে বাবার ঘর থেকে সে।দেখে নিল মা কোথায়। এখন মা'ই ভরসা। মা যথারীতি রান্নাঘরে। টিফিন বানাচ্ছেন। আড়চোখে ঘড়ি দেখল সে। আর ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে রেডি হতে হবে।তারপর স্কুল। কিন্তু কবিতাটার শেষের ক'লাইনের ব্যাখ্যা তো আসবেই।এটা ইম্পরট্যান্ট বলে সুরভীদি মার্ক করে দিয়েছেন। সুরভীদির গা দিয়ে একটা মিষ্টি গন্ধ বেরোয়।যখন পড়ান কিছু তখন সে মুগ্ধ হয়ে শোনে।তাঁরও বাবার সঙ্গে বেশ মিল আছে।মূল বিষয় পড়াতে গিয়ে বিভিন্ন ঘটনার যোগসূত্র তৈরি করেন।ভুগোলে আসাম পড়াতে গিয়ে কামাখ্যা মা থেকে মেখলা মিলেমিশে এক হয়ে গেছিল চা বাগানের কামিনের কান্নার সুরের সঙ্গে। দীনবন্ধু মিত্রর নীল দর্পন নাটকের নীল সাহেবদের চরিত্র এমনভাবেই তিনি পড়াতেন যে সত্যি বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠত নীল চাষীদের কষ্টের দৃশ্য কল্পনা করে।চোখ ভরে যেত জলে। সেই দিদির ক্লাসে এই কয়েকটা লাইনের যদি ঠিক মতো ব্যাখ্যা দিতে না পারে তবে তা ভীষণ লজ্জার। এসব ভাবতে ভাবতেই সে লিখল - ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে সব গড়ে,আবার ভাঙে।মানুষ তার বাহুবলে আদিমকাল থেকে নিজের ক্ষমতা জাহির করার জন্য দূর্বলের ওপর অধিকার প্রয়োগ করেছে।এবং শক্তির জোরে বাধ্য করেছে পারিষদকে তার কাজকর্মের দিনলিপি লিখতে।কিন্তু সময় নিজের মতো করে তার সে অহং মিটিয়ে আবার নতুন গল্প লিখেছে।কিন্তু যারা কোনও কিছুর প্রত্যাশা না করে শুধু মানুষের কল্যানের জন্য, পৃথিবীর ভালোর জন্য কাজ করে গেছেন,তারাই শেষ অবধি ইতিহাসের পাতায় চিরকাল থেকে গেছেন। ক্লাস নাইনের মেয়ে মুনাই ওরফে বিতস্তার সেই চার লাইন ব্যাখ্যার এটাই ছিল ভূমিকা। সুরভীদি বলেছিলেন,বিতস্তা বাবা পড়িয়েছেন না? তাই এত ভালো লিখলি। বিতস্তা ওরফে মুনাই হেসেছিল।কিন্তু বলতে পারেনি সেদিন এগুলো তার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল।সে একদিন ইতিহাসের অংশীদার হতে চায়। ইতিহাস কেউ গড়ে কেউ ভাঙে।কিন্তু স্রোতের মতোই তা প্রবাহমান।বাবার এই কথাটাই কেবল তার মাথায় ঢুকে ছিল।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register