সকাল সকাল সঞ্জীবের ফোন। শীতের কামড় ভালোই পড়েছে, তার মধ্যে এতো সকালে রঞ্জন গরম কমফোর্টারের কমফোর্ট জোন থেকে বেরোতে বেশ বিরক্ত বোধ করলো। ওপাশ থেকে সঞ্জীব বললো , ‘হ্যালো রঞ্জু , তোকে ফেসবুক এ মেসেজ করেছি দেখিসনি বোধয়। রঞ্জু বললো – না রে একটু অফিস এ চাপ যাচ্ছে, ফেবু খোলার টাইম পাইনি। কেন বলতো , গ্রুপ মেসেজ এ তো সেদিন কথা হলো , any urgent মেসেজ কি ? ‘ ওপাশ থেকে — ‘ সরি রঞ্জু তোর টাইম তো আর্লি মর্নিং আসলে আমাদের তো ইভিনিং । রঞ্জন বললো -না ঠিক আছে আর আধ ঘন্টা পর তো উঠতেই হতো। ব্যাপার কি সেটা তো বল ?সঞ্জীব বললো ‘ প্রবাল ভালো নেই রে , গ্রুপে ঠিক বলা যেতোনা তাই পার্সোনাল মেসেজ করেছিলাম তোকে । প্রবাল চেন্নাই তে আছে জানিস তো।’ রঞ্জন বললো ‘ হুম জানি! কিন্তু ও uk তে ভালো কাজ ছেড়ে কেন গেলো সে নিয়ে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল , তারপর থেকে কথা নেই। আর ও তো ফেবু অথবা গ্রুপ এ নেই।’ সঞ্জীব- ‘ ওই চাকরি ছেড়ে চেন্নাই তে একটা কাজ নিয়ে গিয়ে সব গ্রুপ থেকে বেরিয়ে গেছে। মোবাইল নম্বরটাও চেঞ্জ করেছিল। এবার ডিসেম্বর এ কলকাতা গিয়ে দেখা হলো কাকতালীয় ভাবে। কেমন যেন এড়িয়ে যাওয়া ভাব , বললো ছুটিতে এসেছে কলকাতা সাত দিনের জন্য। নম্বর চাইলাম বললো ওটা চেঞ্জ হবে তাই আমারটা নিয়ে রাখলো , বললো নিউ নম্বর হলে কল করবে।তারপর.. আবার যথা রীতি ডুমুরের ফুল।’ রঞ্জন – ‘সে তো বুঝলাম , তা ভালো নেই মানে কি ? আর তুই কন্ট্যাক্ট করলি কি ভাবে ?’ সঞ্জীব- ‘ আরে আমার মাসতুতো বোন চেন্নাই তে আছে , ওর ছেলে নাকি প্রবালের কাছে আঁকা শেখে , ও একটা আঁকার কোচিং ক্লাস শুরু করেছে , কি সব ওয়ার্কশপ করে , ওর বৌ নাকি নাচ শেখায়। ওই uk থেকে জমানো দিয়ে ক্লাস খুলেছে একটা ছোট পুরোনো বাড়ি কিনে।’ রঞ্জন-’ বাহ্ ! তা ভালোই তো , চাকরি ছেড়ে নৃত্য কলা মন্দ কি। কলকাতার বাইরে এইসব এ ভালোই কামাই আছে। ট্যাক্স ফ্যাক্স গুপি করা যায়। ‘
সঞ্জীব এবার একটু শান্ত ভারী গলায় বললো -’ না রে রঞ্জু ওর বৌ আমার বোনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একদিন নাকি কান্নায় ভেঙে পরে বলেছিলো , প্রবাল ভালো নেই। ওর ভালো না থাকাটাই রোগ। মনে আছে ছোটবেলা থেকে কেমন আবেগ প্রবন – আপোষহীন মানুষ ছিল ও।’ রঞ্জন বললো -’ জানি তাই এতো ভালো চাকরি ছাড়ছে দেখে একটু advice দিতে গিয়েছিলাম। আমাকে বললো ‘’আমি গিরগিটি নই রে। … হেঁহেঁ টাও আসেনা। পাউন্ডের পারদ ওঠানামা করবেই ওর লোভে compromise করবোনা। যদিও সেটা তুই বুঝবিনা রঞ্জন ” ভাবতে পারিস সঞ্জীব ও নিজেকে কি ভাবে , আমরা গিরগিটি ? হেঁহেঁ করি। যারা বিদেশে আসতে পারেনা তাদের কমপ্লেক্স বুঝি , কিন্তু নিজে থেকেও এমন বোকামি করবে আর কেউ বোঝালে তাকে অপমান করবে। আমি সে বান্দা নই রে ,তারপর আর তাদের ব্যাপারে মাথা ঘামাবো ! যাই হোক কি হয়েছে মাথা খারাপ নিশ্চয়ই।’
সঞ্জীব এবার থেমে বললো – ‘নিউরোলিজিক্যাল প্রব্লেম। খরচা সাপেক্ষ। মোহনা , মানে প্রবালের mrs আমার বোন কে বলেছে , গয়না পত্র সব গেছে। মেডিসিন গুলো কমপ্লিকেটেড আর এক্সপেন্সিভ। এর মধ্যে ডাক্তার বদল করেছে বার কয়েক। তাই একই circle of tratment এ ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখ রঞ্জু আমরা তো সেই ছেলেবেলার বন্ধু। ফেসবুক পেজে বন্ধুদের থেকে সাহায্য চাওয়াটা কেমন তাইনা ? চল না আমি ,তুই , অনুজা , প্রীতম, সৌমি সবাই যদি কিছু একটা ফান্ডিং করে।’ …..কথা শেষ হওয়ার আগে রঞ্জন বললো- ‘সেই পাউন্ড- ডলার ই কাজে আসে তাহলে কি বলিস। প্রাকটিক্যাল না হলে লাইফ এর পরিণতি ওই পাগলা গারদের মোটা গরাদ বুঝলি ! ‘মেঘের আড়ালে সাদা বেড়াল ‘, ‘সবুজ ঘাসে রক্তের সোঁদা গন্ধ ,’কাঁটার মুকুট ‘ , মনের মুখোশের রং সাদা , এইসব কথাগুলো পাশাপাশি জুড়ে দিলে পাঁচ পয়সার কবিতা হয়। আর্টিস্ট রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় রে salesman এর মতো শিল্প বিক্রি করতে। আপোষহীন কি সে হতে পারে ?
শিল্পীর চুলচেরা বিচার করে শিল্পীর গুণমুগ্ধ ভক্ত নয়, কড়ি ফেলে যে সেটা কেনে সে। ছবি কবি সব কিছুর বিক্রি আছে। আর সেটা বললে, আমি হয়ে যাবো নাকি গিরগিটি। গিরগিটিরাই ভালো থাকে রে সঞ্জীব।’ এতো গুলো কথা এক নিমেষে বলছিলো রঞ্জন। ওপাশ থেকে বেশ কিছুক্ষন শব্দহীন নীরবতা। তারপর সঞ্জীব বললো -’ দেখ, প্রবাল বা ওর ফ্যামিলি কিছু তো বলেনি। এটা আমার মনে হলো যদি কিছু করা যায় …. মানে indirectly যদি কিছুভাবে পাশে থাকতে পারি। ও পাগল তো ছিলই রে শুরু থেকে। গড়পড়তা ভাবনা থেকে এগিয়ে গেলে তাকে তো পাগল ই বলে তাইনা ? আমরা যা দেখতে হয় সেটা দেখি , প্রবাল ওই না দেখা গুলো দেখতো। আমি শুধু বুঝি মোহনা মেয়ে টা আমাদের মতো গড়পড়তা মানুষ, তাই আপোষ হীন লড়াই মেয়েটা একা পেরে উঠছেনা। যদি ওর কোনো হেল্প করতে পারি। ওদের অবস্থাটা অনেকটা অসমান চাকার ঘোড়া দৌড়ে নামার মতো হয়েছে। সবাই কি মহারথী হয় রে। …..সে যাই হোক , রঞ্জু মেসেজ বক্স দেখিস ওদের contact ডিটেলস পাঠিয়েছি তোকে আর বাকিদের। সবাই বললো ফোন করে কথা বলবে , মানে একটা আলোচনা। কিন্তু কেউ আর কিছু বলছেনা। আমাদের হোয়াটস্যাপ gruop এ সবাই আছে। জাস্ট সবাই চুপ করে গেছে। এই শর্মা গিরগিটির ঘুম আসছেনা রে। তাই তোকে ফোন করলাম। প্রবালের কথা ছেড়ে দে ….কিন্তু ওই বোকা সেপাই মোহনার সাথে একটা সাত বছরের ছেলে আছে। কাল বোন হোয়াটস্যাপ এ ওর ছেলের জন্মদিনের ছবিতে প্রবালের ছেলের ছবিটা পাঠিয়েছে। তারপর থেকে আমার পাশে বসে থাকা আমার নয় বছরের পাপনের ভিডিও গেম এ ব্যস্ত মুখ টা দেখলে ওই মুখটা ভাসছে। গড়পড়তা বাবা মনটা অশান্ত হচ্ছে। তাই কি মনে হলো কারোকে না করে তোকে personally ফোন টা করে ফেললাম। আমি তো মাছে -ঝোলে-ঝালে থাকা মানুষ। কিন্তু রঞ্জু তুই তো একসময় গান গাইতিস আর মনে আছে তোর গানের কলি শুনে গানের চিত্রপট আঁকতো পাগলা প্রবাল। আমি ঘাড় গুঁজে স্যার এর হোমটাস্ক করতাম আর তোরা আমার খাতায় হিজিবিজি দাগ টেনে পালাতিস। এই সব মনে পড়ছে। পায়ের নিচে তুলতুলে কার্পেট , 65 ইঞ্চি টিভি স্ক্রিন , নরম চামড়া মোড়া সোফা কোনো কিছুতেই যেন আয়েসের সন্ধ্যে টা দিচ্ছেনা রে ভাই ,তাই ফোন করলাম হয়তো তোকে। চল তোর দেরি হচ্ছে ,তুই তো আমার থেকে ১৪ ঘন্টা এগিয়ে। রাখি এখন।’ …..
ফোনটা নিশ্চুপ হলেও বেশ খানিক্ষন কানের পাশে রঞ্জন ফোন টা চেপে ধরে বসেছিল। বিছানার সামনে দেয়াল জোড়া কাঁচের ফ্রেম। একটা ছবি ফ্রেমের উপর দেখা যাচ্ছে।……. একটি নরম ফিকে রঙের শাড়ি পরে ক্লান্ত শরীরে পায়ে ঝুমুর পরে মোহনা নাচ শেখাচ্ছে, অনেকগুলো কচি ঝাপসা মুখ। তার পাশে ছোট্ট প্রবাল মন দিয়ে ছবি আঁকছে , হঠাৎ সেই ছোট্ট প্রবালের মুখে বৃদ্ধ ক্লান্ত প্রবালের মুখ ছায়ার মতো হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠছে , সারা কাঁচের দেয়াল জুড়ে বিদেশী হেমন্তর ছোঁয়া। লাল-বেগুনি-কমলা-খয়েরি পাতার রং ছেয়ে আছে , তারা গিরগিটির মতো রং বদলাচ্ছে। হঠাৎ ছোট্ট প্রবাল হাতের রং তুলি ছেড়ে পিছন ফিরে বললো চেনা কণ্ঠে -‘ কিরে রঞ্জু গান ধর দেখি ।’