“সহধর্মী” গল্পে দীপান্বিতা বিশ্বাস

“পোড়ামুখী তুই আবার ফিরে এসেছিস”?
উঠোন ঝাড় দিচ্ছিলেন চম্পার মা, মেয়েকে আসতে দেখে ঝাটা ফেলে তেড়ে এলেন।
“ওরা আবার আমাকে তাড়িয়ে দিলো মা”
“কেন রে মাগী আবার কি করেছিস তুই? সুখ মোটে সহ্য হয়না তোর! কার সাথে শুতে গেছিলি আবার?”
চম্পা মাথা নিচু করে তার সৎ মায়ের মুখ ঝামটা শুনে চলেছে। তার পিঠের ব্লাউজের ফাঁকা অংশ এখনো নখের আঁচরের দাগ, চোখের নীচে কালশিটে।
কিছু না বলে চম্পা ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। ঘর বলতে বেড়া দিয়ে ঘেরা টিনের ঝাউনি। বাবা দিনমজুর, মা লোকের বাড়িতে কাজ করে। তার মা যখন মারা যায় তখন তার বয়স তিন বছর, বাবা তার মুখের দিকে তাকিয়ে আর একটা বিয়ে করে। তবে এখন সে বোঝে সবই শরীরের জ্বালা। “এ জ্বালা বড়ো জ্বালা”।
ঘরে ঢুকে চোখ পড়ে তার একুশ বছরের ঘুমন্ত ভাইয়ের দিকে।
“এখনো ওঠেনি!” বলেই ঠেলা মারে, ভাই চোখ খুলে দেখে দিদি এসেছে বাড়ি। গলা জড়িয়ে ধরে দিদির, “নে অনেক হয়েছে, এবার উঠে পড় ভাই” বলে চম্পা।
সৎ ভাই বোন হলেও ছোট থেকেই দুজন দুজনকে চোখে হারায়। পদ্ম পুকুরে একসাথে ছিপ ফেলে মাছ ধরা, হারান দের পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করে খাওয়া থেকে শুরু করে কালবৈশাখীর সময় আম কুড়ানো সবই চলতো দুজন মিলে।
শরতের সকালের মেঠো রোদে যখন চারিদিকে কাশফুলে ছেয়ে যেত, পলাশডাঙার বিলে পদ্ম তুলতে যেত দুজন। পুজো এলে দুজন দুজনার হাত ধরে গ্রামের পুজোয় দুগ্গা ঠাকুর দেখতে যেত।
ঠাকুর দেখে ফেরার সময় দিদির কপালে একটা চুমু খেয়ে সূর্য বলতো “জানিস দিদি তোর চোখটা ঠিক দুগ্গা ঠাকুরের মত”। চম্পা লজ্জা পেয়ে সূর্যকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতো।
বীরেন কাকু যেদিন চম্পার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এলেন, লজ্জায় লাল হয়ে চম্পা পুকুর ঘাটে গিয়ে বসে ছিল।
রাতে সূর্য তাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল।
“দিদি তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?”
“আমি তো মাঝে আসবো সোনা, এমন করে কাঁদতে আছে নাকি”? বুকের মাঝে নিয়ে সে রাতে ভাইকে অনেক আদর করে দিয়েছিল চম্পা।
বিয়ে হয়ে গেল চম্পার, বিয়ের দিন সারাদিন সূর্য খুব কেঁদেছিল। তবে চম্পা বিয়ের আনন্দে মেটে ছিল!
কিন্তু বিয়ের এক মাস পরেই চম্পা বুঝতে পারলো, তার স্বামী তাকে সব সুখ দিতে পারবে না কোনদিন। রাতে শোবার সময় চম্পা তার শাড়ি ব্লাউজ সব খুলে তার স্বামীর বুকের উপর ঝুকে পড়লেও নিত্যানন্দ তার দিকেও ফিরেও তাকাতো না কোনদিন। প্রথম প্রথম ভেবেছিল নিত্যানন্দের হয়তো অন্য কোনো মেয়েমানুষের সঙ্গে লটরপটর আছে কিন্তু ধীরে ধীরে চম্পা বুঝলো মেয়ে মানুষ দেখলে নিত্যানন্দ আরো বেশি গুটিয়ে যায়।
পাশের বাড়ির দেওর মিলনকে দিয়েও অনেক খোঁজ করেও বেশি সুবিধা সে করতে পারলো না।
বাজারে মুদিখানার দোকান নিত্যানন্দের, শ্বশুরবাড়ি পাশের গ্রামেই। ছোট থেকে ঘরকুনো সে নিজের মত থাকতে ভালোবাসে, বন্ধু নেই বললেই চলে। তবে বিয়ের পর শালা সূর্যর সঙ্গে বেশ সখ্যতা হয়েছে। মাঝে মাঝে চম্পাকে না বলে শ্বশুরবাড়ি চলে যায় সে, তারপর খেয়ে দেয়ে সূর্যের সঙ্গে গল্প করে বাড়ি ফেরে।
এমন করে এক বছর কেটে যায়, শারীরিক সুখ সে কোনোদিন চম্পাকে দিতে পারিনি। প্রথম প্রথম চম্পা খুব জোর করতো, এমন কি ল্যাংটা হয়ে চেপেও ধরতো তাকে; ঠেলে সরিয়ে দিতো সে চম্পা কে।
সেদিন দুপুরে কেউ বাড়ি ছিল না, নিত্যানন্দ তখন দোকানে। তার বাবা মা পাশের গ্রামের কীর্তন শুনতে গেছে, মিলনকে নিয়ে ঘরে দোর দিয়েছিল চম্পা।
সেদিনই প্রথম শারীরিক সুখের তৃষ্ণা মিটিয়েছিল চম্পা, তবে দরজা খুলতেই বারান্দায় বসা তার শ্বাশুড়ি চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে ঘর ছাড়া করেছিল।
প্রায় একমাস চম্পা বাপের বাড়ি ছিল তখন, নিত্যানন্দ অবশ্য দুদিন অন্তর যেত শ্বশুরবাড়ি।
শেষে চম্পার বাবা নিত্যানন্দের বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে মেয়েকে আবার শ্বশুরবাড়ি পাঠায়।
আজ আবার মুখ কালো করে চম্পা বাপের বাড়ি এসে উঠেছে, এতে অবশ্য তার লজ্জা টজ্জা করেনা। করবেই বা কেন! বিয়ের পর তিনবেলা খাওয়া ছাড়া আর কি পেয়েছে সে!
নিত্যানন্দ তার দিকে চেয়েও দেখে না কোনোসময়।
সেদিন দুপুরে সূর্য কলতলা থেকে স্নান সেরে ঘরে ঢুকতেই চম্পার চোখ পরে তার ভেজা শরীরের দিকে। বহুক্ষণ তাকিয়ে ছিল চম্পা তার ভাইয়ের দিকে। সূর্যও বুঝেছিল, আড়ালে মুচকি হেসেছিল শুধু।
সেদিন দুপুরে চম্পার মাকে মিনতি দি কোনো একটা কাজে ডেকেছিল, এদিকে চাল বাড়ান্ত। যাওয়ার আগে চম্পাকে বলে যায়-
“দোকান থেকে চাল এনে হাঁড়ি বসিয়ে দিস চম্পা, আমি একটু মিনতির দির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। দেখি কি কাজ করতে ডাকে”।
“আরে কী করছ! আস্তে…”
“লাগছে সোনা?”
“উমমমম…”
চম্পা ডুবে যাচ্ছে সুখের আবেশে। সূর্যর পুরুষত্ব সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।
হঠাৎ বাইরে থেকে আওয়াজ এল একটা।
ঠক্ ঠক্। কড়া নাড়ার শব্দ।
একলাফে উঠে দাঁড়াল সূর্য। “তোর দিদি কী এর মধ্যে দোকান ফিরে এল নাকি!”
সুখ সয় না চম্পার কপালে। চিরদুখিনি মেয়েটা আস্তে আস্তে শাড়ি ঠিক করতে করতে পেছন দরজা দিয়ে এগোয় দোকানের দিকে।
দুদিন বাদে আজ নিত্যানন্দ এসেছে চম্পাদের বাড়ি। চম্পা অবশ্য কথা বলেনি, রান্না বান্না করে খেতে দিয়ে সে পুকুরঘাটে বসে ছিল। সারাদুপুর সূর্যের সঙ্গে গল্প করে বিকেলে সে আবার ফিরে যায়।
“দিদি এইনে নিত্য দা তোর জন্য এটা এনেছে”। একটা শাড়ি চম্পার হাতে দিয়ে বলে সূর্য।
লাল রঙের একটা শিফনের শাড়ি। শাড়িটা পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চম্পা, এই প্রথম তার স্বামী তাকে ভালোবেসে কিছু দিলো।
“আজ রাতে এই শাড়িটা পরবি তুই দিদি, আজ রাত শুধু তোর আর আমার”।
চম্পা কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
পর দিন সকালে পুকুর ঘাটের আম গাছ থেকে চম্পাকে ঝুলতে দেখা যায়, তার বাবাই প্ৰথম দেখে।
শ্মশান থেকে ফিরে সবাই বারান্দায় বসে আছে। চম্পার স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি সবাই এসেছে।
সারাদিন দরজা খোলেনি সূর্য, সবাই অনেক ডেকেও তার সাড়া পাইনি। শেষবার দিদির মুখ অবধি সে দেখেনি।
সবাই বলা বলি করছে শোকে পাথর হয়ে গেছে সে।
চম্পার মা নিত্যানন্দের কাছে এসে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললো-
“বাবা যা হবার তো হয়েই গেছে, আমি আমার ছেলেকে হারাতে পারবোনা। তুমি একবার দেখো বাবা সে যদি দরজা খোলে। কিছু যদি মুখে দেয়, ছেলেটা আমার সারাদিনে জল অবধি ছোঁয়নি।”
নিত্যানন্দ উঠে গিয়ে সূর্যের ঘরের সামনে দাঁড়ায়, বার কয়েক ডাক দিতেই এবার সূর্য দরজা খোলে।
বাইরে তখনও সবাই নিঃশ্চুপ, ঘরের ভিতর নিস্তব্ধ দমফাটা হাসির স্রোত।
একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে সূর্য আর নিত্যানন্দ। সূর্য ধীরে ধীরে নিত্যানন্দের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো, উঠোনে ঝুপ করে অন্ধকার নামলো।
“আমাদের আর কেউ আলাদা করতে পারবে না সূর্য” বলে ওঠে নিত্যানন্দ।
“আর বলোনা কত কষ্ট করে কাল রাতে বিষ মেশানো দুধটা খাইয়েছিল ওই শালী কে। সে মোটে খাবে না, বলে আগে তুই খা তারপর আমি। কোনোভাবে জোর করে খাইয়ে দি, তারপর ধীরে ধীরে গোটা শরীরে চুমু খেতে শুরু করি। তারমধ্যেই তার জ্বালা শুরু হয়, তখন বেশ গোঙাতে থাকে। বাবা মা বুঝে যাওয়ার আগে মুখে বালিশ চাপা দিই।”
-“মাগীটা আবার তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছিল, দিয়েছি তো অব জ্বালা মিটিয়ে।”
-অবশ্য রাতে তুমি না এলে আমি একা একা পুকুর ঘাটে নিয়ে গিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে গাছে ঝোলাতে পারতাম না”।
বাইয়ে থেকে ডাক দেয় সূর্যের মা।
“বাবা এবার কিছু খেয়ে নে। দেখ তোর জামাইবাবুও কিছু খায়নি সারাদিন”।
দরজা খুলে একে অপরের হাত ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সূর্য আর নিত্যানন্দ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।