T3 || ঘুড়ি || সংখ্যায় চিরঞ্জীব হালদার

গ্ৰামীন ঘুড়ির চালচিত্র
ধরুন আজ বিশ্বকর্মা পূজা। অথবা আপনার কল্পনায় কোন একদিন বিশ্বকর্মা পূজা আসছে। সময়টা ভাদ্র মাস না হলেও হতে পারে। ধরা যাক ইবসেন বা র্্যঁলা কখনো বিশ্বকর্মা পুজো দেখেছেন বা দেখেননি। অথচ এশীয় মহাদেশে এই যে ঘুড়ি ও তার উড়ান ভাবনা কিভাবে কিশোরদের এক মনোরঞ্জনের কারণ হয়ে উঠল সে এক অন্য ইতিহাস। জাপানিরা তো ঘুড়িপ্রিয় জাতি। যেদিন হিরোশিমা ধ্বংস হয় তার আগের দিন শহরের কোন কোন কোণায় ঘুড়ি উড়েছিল তার কোন কাল চিহ্ন কোথাও নেই।
আমাদের মফস্বলে মানে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় ঘুড়ি নামক কাগজের পতঙ্গ উড়তো শীতকালে। ধান ক্ষেত আদিগন্ত খাঁ খাঁ।দু’হাত মাথার উপর তুলে চোঁ চোঁ লাটাই দৌড়।ঘুড়ি বেশি মাথা কাঁপালে উপরের কল্কায় দুটো ডবগা দাও। আর বেশী লাট খাওয়া ঘুড়ি বাগ মানাতে নিচের কল্কায় দুটো ডবগা দাও।
৭০ বা আশির দশকে বার্ষিক পরীক্ষাটা শেষ হতে হতে নভেম্বর ফুরিয়ে যেত।
সহপাঠীর সাথে পরিকল্পনা করা হতো কে কোন রঙের মাঞ্জা দেবে। ক্যাবলা ডাক্তারের ডিস্পেন্সারি থেকে শুনশান দ্বিপ্রহরে ইনঞ্জেকসানের খালি কাচের ছোট শিশি জড়ো করা পরিকল্পনা করা হতো। নোনতা বালির দোকানে মাঞ্জা দেওয়ার বিশেষ আঠা শ’দরে কিনতে হতো ।সে এক প্রবল উত্তেজনার রাত যেদিন বার্ষিক পরীক্ষার শেষ হতো। হোসেন স্যার মজা করে বলতেন কি রে কবে মাঞ্জা দিবি ।তার আগে ভালো করে উত্তর মিলিয়ে নিস। না হলে ঘুড়ির লাটের মতন অংক ও লাটে উঠবে। গ্রামে ঘুড়ির দু-চারটে নামের চলন ছিল। পেটকাটা, চাঁদিয়াল ,চৌরঙ্গী এই পর্যন্ত। দুই তিন বন্ধু না জুটলে মাঞ্জা জুতসই হতো না।জুটেও যেতো। মায়ের কাছে বায়না ধরে দু টাকা যে কোনভাবে সবাই যোগাড় করতো। দু টাকার তিন’শ গ্রাম আঠা। দু টাকার এরারুট। দু টাকার তিন রকম রং সবমিলিয়ে মাঞ্জার আখরি সরঞ্জাম। একজন ইনজেকশনের শিশি ভালো করে ধুয়ে কাগজ বাদ দিয়ে সফসুরত করতো।একজন জোগাড় করত প্রাচীন শিল আর নোড়া। একজনের উপর ভার থাকতো ইট যোগাড় করে উনান বানানো আর পরিমাপ মত জ্বালানি যোগাড় করা। তিনটে ইট দিয়ে বানানো হতো উনান। জ্বালানি বলতে যত্রতত্র পড়ে থাকা খড় বিচুলি ও কাঠের টুকরো টাকরা।কখনো কারো গোয়াল ঘরে হানা দিয়ে জ্বালানি কাঠ ও চুরি করে আনা হতো।নতুন মালসায় জল দিয়ে ফোটানো হতো কেনা আঠা। মূল হোতার নজর থাকত ঠিক কখন জল দিয়ে ফোটানো আঠায় মিহি কাঁচের গুঁড়ো মেশাবে। আর কতক্ষণ সেটাকে ফুটানো হবে। সময় মত এরারুট দেওয়া হতো পরিমাণ মত যাতে কাচের সূক্ষ্ম গুড়ো ঠিকমতো সুতোতে ধরে রাখতে পারে শেষ অবধি।এভাবে মাঞ্জার লেই প্রস্তুত করা হতো। কেনা আঠার সাথে মেশানো হতো সজনে গাছের আঠাও। এ ব্যাপারে অবশ্য গোপালি সিদ্ধ হস্ত। জল আঠা দিয়ে একসঙ্গে মিহি কাঁচের চূর্ণে মিশিয়ে বেশ একটা বাদামি রোমাঞ্চকর লেই বানানো হতো। আর পরিমাপ এমন হতো যাতে তিন লাটাই সুতোয় পুরো মাঞ্জা দেওয়া যায়। তারপর যে যার পছন্দ মতো তিন ভাগে মেশানো হতো রং।
সবাই জড়ো হতো দুপুর দুপুর বাদামতলার মাঠে।
এখন অবশ্য সেই সব মাঞ্জা দেওয়া ছেলেপেলেরা কেহ কারো প্রবল শত্রু ।কেউ পুরো ঈর্ষাবাজ ।কেউবা চরম শয়তান প্রকৃতির। সেই ডিসেম্বরের দুপুর আর মাথা খুঁড়লেও খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
২
চূড়ান্ত মাঞ্জা দেওয়ার সময় বড় কাউকে দিয়ে টেস্ট করানো হতো যাতে মাঞ্জা কখন ঠিকঠাক জুৎসই লাগাতে হবে। যাতে প্রতিপক্ষ ঘায়েল হয় ।বেশ এক যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। যা শুরু হয় সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার কাল থেকে। যতই নাচন-কোদন করো না কেন ঠিক ঠিক মাঞ্জা দিতে না পারলে সব ভোকাট্টা। মাঞ্জা দেওয়ার চূড়ান্ত কাজ ঠিকঠাক সম্পন্ন না হলে সবাই এক গোয়ালের গরু।
কেউ পছন্দ করত সুতো ভিজিয়ে মাঞ্জা লাগাতে ।কেউবা শুকনো সুতোতে সরাসরি মাঞ্জা দিতে ।বাদামতলার মাঠে ৫০ মিটার ব্যবধানে দুটো শক্ত খুটি লাগানো হতো।একজন লাটাই থেকে সুতো ছাড়তে ছাড়তে দুই খুঁটির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চলে যেতো। আর একজন ভিজে কাপড় নিয়ে প্রস্তুত ।তৃতীয় জন কাপড়ের পুটলিতে মাঞ্জার কাই নিয়ে প্রস্তুত। শেষ জন থাকতো কম পরিমাণ কাই হাতের টিপে সুতো বরাবর চলে যেতো। তারপর শুকানোর পালা। কোথাও কোন অতিরিক্ত আঠা যাতে সুতোয় লেগে না থাকে যা খুব বিপদের কারন হতে পারে সেদিকে সবার নজর থাকতো।
একটা অলিখিত শর্ত থাকতো এই মাঞ্জা দেওয়ার সহযোগীরা কখনো নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি খেলতো না ।যা হত এ পাড়া ও পাড়ার মধ্যে বা মাঠে ঘুড়ি উড়ালে এ গ্রাম ও গ্রামের মধ্যে চলতো কাটাকুটি ।এ পাড়ার বাবলু যদি ঘুড়ি ওড়ানো হিরো তো সিংহ পাড়ার তোপসে আর এক হিরো।গ্রামে সম্পন্ন কৃষকবাড়ির ছেলেরা তাদের ছাদেই ঘুড়ি ওড়ানেতে বেশ অহং অহং ভাব দেখাতো।
তারা কখনো নিচে মাটিতে নেমে ঘুড়ি ওড়াতো না।
সিংহ বাড়ির ছাদে পেটকাটি উড়ছে তো হালদার বাড়ির ছাদ থেকে চৌরঙ্গী লাট দিচ্ছে।
সব থেকে মজার যেটা সেটা হল কমপক্ষে ২০০ মিটার সুতো ছাড়ার পর চলতো কাটাকুটির প্রপাগান্ডা।যার ঘুড়ি যত উঁচুতে তার তত দেমাগ।
নিচের সংসারিক মানুষজন শুধু দুলপো বা ভোকাট্টা শুনতে অভ্যস্ত। যা ডিসেম্বরের সকাল এক প্রাণবন্ত চিৎকারে ভরে উঠতো। গ্রামে কোন কাকা বা জ্যাঠাকে এই কাটাকুটিতে ভিড়তে দেখিনি ।না কোন তন্ধী কিশোরীকে। বামুনপাড়ার সলিল বনাম হালদার পাড়ার দীনেশ এর মধ্যে চলত তুমুল কাটাকুটি। কে কত সেয়ানা ,কার কত দম এই ডিসেম্বরে প্রত্যেকে জানান দিত। এটা অবশ্য মানতেই হতো অনেকেই খারাপ মাঞ্জা দিয়েও হাতের গুনে বেপাড়ার অনেক ঘুড়িকে ঘোল খাইয়ে মাঝ আকাশে বেসাহারা করেছে ।অনেক সময় শহর থেকে বেড়াতে আসা বগলা বেশ হিরো হয়ে উঠতো সিংহদের ছাদে। এক লপ্তে সে ভাসিয়ে দিত আর দশটা কাটিপতঙ্গ মাঝ আকাশে।
সেই স্বপ্নালু দিন এখন আর আছে কিনা গ্রামে জানা হয়ে ওঠেনি।