।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় লিপিকা ঘোষ

হোম ডেলিভারি

পরশু রাতের প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টিতে রবির চালের দুটো টিন উড়ে গেছে। বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে সারারাত চারজনে চৌকির নিচে গুটিশুটি দিয়ে বসে ছিল। ঘরের জিনিস পত্র সব ভিজে গেছে। আজ সকাল থেকে রবির মেয়ে মুন্নির জ্বর। বারান্দায় শুয়ে মুন্নি ওর সিক্সের বইগুলো দেখছিল। পড়শু রাতে বই গুলো সব ভিজে গেছে । আর রোদ ওঠেনি যে শুকাবে । মুন্নি দু মাস স্কুলে যায় নি তো কি হয়েছে,রোজ পড়তে বসে।
রবির বৌ প্রতিমার হোম ডেলিভারির ব্যবসাটা ছিল বলে সংসারটা টানতে পারছে। রেশনে তো শুধু চাল আর গম দেয়! মাঝে মাঝে মুন্নির স্কুল থেকেও চাল, আলু দেয়। কিন্তু জ্বালানি,তেল, মশলা, সংসারের বাকি খরচ তো জোগাড় করতে হয়! প্রতিমার হাতের রান্না ভালো। ছোটবেলায় ঠাকুমার কাছে রান্না শিখেছে। শিখেছে কি করে কম তেল মশলায় তরকারিতে স্বাদ আনতে হয়,কি করে ফোড়নের গন্ধ আনতে হয়। আর শিখেছিল রান্নার তাক , মানে সঠিক সময়। কোন তরকারি কতক্ষণ ফোটাবে, কখন নামাবে ,সেটা রাঁধুনিকে বুঝে নিতে হবে। ঠাকুমা বলতেন, রান্না হোক বা জীবন, তাকই সব। তাক না বুঝলে যতই মশলা দাও স্বাদ জমবেনা।
আগে আরো কত রাঁধতে হত প্রতিমাকে! গোধূলি ফ্ল্যাটের দোতলার দাস বাবু আর একতলার মাসিমারা খাবার নিত। লকডাউন হয়ে থেকে ফ্ল্যাটের গেট বন্ধ করে দিয়েছে । পাড়ায় বাচ্চার জন্ম দিন হলে অর্ডার পেত। এখন তাও বন্ধ । থানার মেস বন্ধ হয়ে যাবার পর প্রতিমা ওদের রান্না করে দিত। ওরা চাল,ডাল,আনাজ কিনে দিত,প্রতিমা রাঁধত। থানার পুলিশ ছাড়াও চোর চোট্টাদের জন্যও রাঁধতে হত। আর যাদের পুলিশ কুড়িয়ে পেত
,রাস্তার ধারে, পার্কের মুখে,সব মিলিয়ে দশ পনেরো জন হবে। তাদের জন্যও দুবেলা রান্না করতে হত। এখন তো থানার লক আপ ফাঁকা। এখন শুধু থানার চার জনের জন্য প্রতিমা কে রাঁধতে হয়।
আগে রবি সকালে অটো নিয়ে বেরোত। ভাড়ায় আটো চালালেও দু পয়সা হত। আজ দু-মাস রবি বসে আছে। যা দুটো পয়সা জমে ছিল লকডাউনের বাজারে সব শেষ হয়ে গেছে। কর্পোরেশনের দয়ালবাবু ঝড়ে পড়া গাছ কাটার জন্য রবির ছেলে রাজাকে ডেকে নিয়ে গেছে। রাজার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বাকি দুটো কবে হবে ঠিক নেই। ঝড় হয়েছিল বলে এই লকডাউনের বাজারে একটা কাজ পাওয়া গেল।
প্রতিমা রান্না করতে করতে ভাবে মানুষ জাতটাকে ঝাড়েবংশে নির্বংশ করতে চাইছে এই করোনা। কাজে বেরোলে ছোঁয়া লেগে মরতে হবে, না বেরোলে না খেয়ে মরতে হবে। তা মারবি মার যত বদমাশ এগুলোকে বেছে বেছে মার! যারা খাবারে ভেজাল মেশায়,রাতে মেয়ে তুলে নিয়ে যায়,হিন্দু মুসলমান ঝগড়া বাধায়, গরিবদের ঠকিয়ে বড়লোক হয়, তাদের মার! রেশন দোকানের পচা দত্ত অর্ধেক চাল ডাল ওজনে মেরে দিচ্ছে। ওজন মেশিনটা কমিয়ে রেখেছে। যাতে পাঁচ কেজিকে সাত কেজি মনে হয় । এদের মত যারা লোকের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় তারা করোনায় দুদিন ভুগলেও মনটা শান্তি পায় ।
প্রতিমা রান্না করে আর গোধূলি ফ্ল্যাটের দাস বাবু ও দুই মাসিমার কথা ভাবে! ঝড়ের পরে কারেন্ট চলে গেছে। পাম্প চলছে না, জলও উঠছে না। রাস্তার কলে জল নেওয়ার হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে কাল থেকে। বুড়ো মানুষগুলো কি করছে কি জানি! কাল থেকে ওদের ফ্ল্যাটের মেন গেট খোলা আছে। রবিকে দিয়ে এক ড্রাম করে জল পাঠিয়ে দেবে ভাবে। প্রতিমার তো ঘরের পাশে কর্পোরেশনের কল! সঙ্গে একটু তরকারিও পাঠাবে ভাবে। ওরা হয়ত ভাতে-ভাত খাচ্ছে এ কদিন। দাস বাবুর ছেলে বৌমা তো স্পেনে থাকে। এখানে আসেও না,দেখেও না। দাসবাবু নিজেই একটু ভাত ফুটিয়ে নেয়, বৌটা তো পঙ্গু ! উঠতে পারে না। যে বয়সে ছেলে-বৌ, নাতি-নাতনি নিয়ে সুখে সংসার করার কথা, নিশ্চিন্তে জীবনের সব দায়িত্ব ছেলের কাঁধে চাপিয়ে দেবার কথা সে বয়সে ফাঁকা সংসারে অসহায়ের মত হামাগুড়ি দিচ্ছে । জীবনের কোথায় ওরা তাক ভুল করেছে কে জানে!
একতলার মাসিমারা দুই বোন, নিজেরা যা পারছে তাই খাচ্ছে । ছোট মাসিমা বিয়ে করেনি। বড় মাসিমার মেয়ে জামাই বিদেশে চাকরি করে তাই নিজের কাছে মা-মাসিকে রাখতে পারে না। যাঁরা কষ্ট করে বড় করল শেষ বয়সে তাদের পাশে থাকতে পারবে না,যত্ন আত্তি করতে পারবে না, অমন চাকরি করার কী দরকার?
প্রতিমার রান্না শেষ হলে রবি এসে খাবার নিয়ে থানায় দিতে গেল। প্রতিমা রাজার পুরানো জামা কেটে মাস্ক বানিয়েছে। রবি পড়েছে তারই একটা। রবি থানার সামনে গিয়ে দেখে সেখানে সাংঘাতিক গন্ডগোল চলছে । থানার ভিতরে ভাঙচুর চলেছে । যদিও এমন ঘটনা নতুন নয় থানায় প্রায়ই এরকম হয়। চোর ডাকাত যাকেই তুলে আনুক থানা ঘেরাও করার লোকের অভাব হয় না । একটু এগোনোর পর বুঝতে পারল আজকের বিক্ষোভটা অন্য রকম। থানার পুলিশরাই থানা ভাঙচুর করছে। কিছু লোক মাস্ক পরে থানার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে। করোনাকে সবাই ভয় পায় । ওদের কাছে জানতে পারল থানার বড়বাবু আজ সকালে মারা গেছেন । ওনার ক’দিন থেকে জ্বর জ্বর লাগছিল। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল কিন্তু সেখানে চিকিত্সা হয়নি বললেই চলে। প্রথম কিছু দিন তো কোয়রেন্টিন সেন্টারে ফেলে রেখেছিল। ঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে বড়বাবু মরতেন না। তাই ক্ষোভে ফেটে পড়েছে থানার বাকি পুলিশ। বড়বাবু থানাতেই থাকতেন, ওনার সঙ্গে আরো তিনজন থাকত । বেলে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে ওখানকার নেতাজি ক্লাবে রোজ এক হাজার লোকের রান্নার ব্যবস্থা করেছেন । সেখানে পাড়ার ছেলে গুলো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাটছে। রাজাও রোজ জল তুলে, চাল ধুয়ে, আলু ছুলে দিয়ে আসছে। লাইন দিয়ে খাবার নিচ্ছে কত লোক । লকডাউনে কম লোক কাজ হারিয়েছে? রবির মতো অটো চালক,ছোট দোকানদার,দোকানের কর্মচারী হকার, রাজমিস্ত্রি,কাঠের মিস্ত্রি,কন্ডাক্টর,ড্রাইভার,ইস্ত্রি-বালা,তাছাড়া যারা পুরনো ছাতা-জুতো সেলাই করে , যারা দিন আনে দিন খায়, সবাই কাজ হারিয়েছে । ওরা যা রোজগার করে তাতে খেয়ে দেয়ে কী আর জমে যে মাসের পর মাস বসে বসে খাবে? এখন এই রান্নাঘরই তাদের ভরসা । দলে দলে লোক আসে খাবার খেতে। রাজা রাতে ওখান থেকে বাড়ির জন্য খাবার নিয়ে আসে। কিন্তু দুপুরে বাড়িতেই খায়। লোক লজ্জার ভয়ে আনে না ।বড় হয়ে প্রেস্টিজ হয়েছে । ঐ রান্নাঘরের খাবার আর সবাই খেলেও বড়বাবু,বিনয়বাবু আর দুজন কন্স্টেবল খেত না। ওরা চারজন রবির বাড়ি থেকে খাবার নিত। বড়বাবু হসপিটাল যাবার পর থেকে তিন জনের খাবার যাচ্ছিল । রবি শুনল বিণয় বাবুরও নাকি করোনার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। ওদের ভয় হচ্ছে যে চিকিত্সার অভাবে ওনাকেও না মরতে হয়! দিন রাত এক করে সবার ভালোর জন্য ওরা এত খাটছে অথচ ওদের জীবনের কোনো দাম নেই! রবির বন্ধু বিধান ওখানে ছিল। রবিকে বলল ,”তুই ও করোনা টেস্ট করিয়ে নে। ঠিক সময়ে ধরা পড়লে বেঁচে যাবি। টেস্টে পজিটিভ এলে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করাস। হসপিটালে ভিড় বাড়াতে যাস না ।” আতঙ্কে রবি আর দাঁড়াতে পারল না। দিশে না পেয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
গতকাল সন্ধ্যা থেকে রবির কাশি আর গলা ব্যথা। মুন্নির সকাল থেকে জ্বর। ভেবেছিল বৃষ্টিতে ভিজে এসব হয়েছে। কিন্তু থানায় এসে রবির সে ধারনা পাল্টে গেল। এবার হয়ত রবির গোটা সংসারটা শেষ হয়ে যাবে ! কিংবা কেউ বাঁচবে কেউ মরবে। যদি শুধু ছেলে মেয়ে দুটো বেঁচে থাকে তাহলে ওদের মানুষ করবে কে? কে চারপাশের আপদ বিপদ থেকে রক্ষা করবে? কে বিয়ে থা দেবে? আমাদের ছাড়া কি ওরা বাঁচতে পারবে? আর যদি উল্টোটা হয় তাহলে—আর ভাবতে পারে না রবি!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।