কবিতা সিরিজে বদরুদ্দোজা শেখু

মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার অন্তর্গত ঠাকুরপাড়া গ্রামে ইং ১৯৫৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সাইফুদ্দীন সেখ ক্ষুদ্র চাষী, মা ফজরেতুননেশা বিবি গৃহবধূ। কবি শিক্ষায় গণিতশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর, নেশায় লেখালিখি। বিবাহিত।শোভা গোস্বামীকে বিয়ে করেছেন। এ যাবৎ কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ---- অলৌকিক আত্মঘাত, দুঃস্বপ্নের নগরে নিভৃত নগ্ন,শব্দ ভেঙে সংলাপ , আরো থোড়া দূর (২০১৯ )এবং পরী ও পেয়ালা (২০২০ ) । কবিতা প্রকাশের উল্লেখযোগ্য পত্রপত্রিকা---- অদলবদল, সপ্তাহ,পূর্বাভাস,জাগরী ,দৌড়, কবিতীর্থ প্রভৃতি । কবিতালেখায় কবি কাব্যতরী, কথাওকাব্য, কুসুম সাহিত্য অঙ্গন ,চন্দ্রমল্লিকা ,শব্দনগর, একুশে বর্ণমালা, কল্পকথা সাহিত্য পরিক্রমা প্রভৃতি সাহিত্য গোষ্ঠী থেকে একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন। কবি অল্পস্বল্প অণুগল্প ও ছোট গল্পও লিখেন।

১| অবােধ কলায়

বহুদিন পর কী একটা কাজে হঠাৎ
একদিন আমাদের সেই পুরাতন
হাইস্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম একা,
ওখানে মেট্রিক পাশ করেছি সুনামে,
দামে কিন্তু হেরে গেছি ট্যাঁকের মাশুলে
তবু ভুলে স্কুলকেই অলক্ষ্যে সালাম দিলাম।
অন্তত বিশ বছর পর
ডিগ্রীর সার্টিফিকেট তুলতে কলেজে গেলাম,
ফটকে দাঁড়িয়ে সেদিনের
সেই পাজামা-পাঞ্জাবী পরা অন্তরাল তরুণকে ডেকে
মেলালাম ল্যাবরেটরীর বারান্দায়,
দ্বিধায় দ্বিধায় শুধালাম স্যারদের কথা
অনেকেই চ’লে গেছেন বদলি হয়ে, হাজরা বাবুর
সাথে দেখা হল বাইরের মাঠে, বটানি টীচার,
পরিচয়ে চিনলেন, চোখ মুখে বিস্মিত আনন্দ
উপচে’ এলাে উভয়ের ,চার-পাঁচটা পড়ুয়া নিয়ে তাঁর
সেদিনের ক্লাশ দরদে ভাস্বর, এর বেশী আর কি চায়?
স্মৃতি-ভারাতুর মনে ফেরার সময়
অলক্ষ্যে কলেজকেই সালাম দিলাম।
কালেভদ্রে গাঁর বাড়ি যাই।
ঘুরতে ঘুরতে কখনো সন্ধ্যায়
একদা যেখানে আমাদের প্রাইমারী স্কুল ছিল
( আজ নাই) সেই বয়ােবৃদ্ধ পাকুড় তলায় গিয়ে
দু’দণ্ড দাঁড়াই আনমনে, সহপাঠীদের মুখ
আবছা আবছা মনে ভাসে, কে কোথায় জানা নাই, যেমন
সেই স্কুলের ভিটেমাটি সব বেদখল আজ, সাক্ষী শুধু
বুড়াে পাকুড় গাছটা বিষন্ন একাকী।
পাখি-খাওয়া লাল লাল পাকুড় বীচির কথা
মনে পড়ে, পকেটে পুরেছি কতো কুড়িয়ে কুড়িয়ে।
আজকাল জায়গাটা চেনা বড়ো দায়।
তবু সেই অদৃশ্য স্কুলকেই অলক্ষ্যে সালাম জানাই।
অন্তরে মাঠের বীজ ধানের প্রত্যয়
শহরে বসত করি, গ্রামে মন রয়
বিষয়-আশয় নয়, বিবর্ণ অতীত
অস্তিত্বের অন্তরালে সদা গড়ে ভিৎ,
ভিড় করে ছােট ছােট সুখ দুখ স্মৃতি
হাতছানি দিয়ে ডাকে প্রাণের প্রতীতি।
তার মাঝে মান্যবর শিক্ষাগুরুগণ
যাদের ঋণের দায় বই আজীবন
অন্তরে, আদর্শ-সম বহ্নিমান জ্যোতিঃ
পাঠভবনের মাটি ছায়া সরস্বতী
অন্তরালে একীভূত অমৃত অনল
আনন্দের স্বর্গরাজ্যে দ্যায় পরিমল।
সেই বােধ সেই ব্যথা বুক জুড়ে থাকে,
কখনো আলোয় হাসে, কভু মেঘে ঢাকে
কভু ডাকে আন্তরিক উষ্ণ অভিধায়
যেমন ফেরাতে চায় বিষণ্ণ বিদায়
পিছু পিছু দরজায় এসে, অনন্তর
বহুক্ষণ চেয়ে থাকে ফেলে-আসা পথের উপর।
সেই বোধ অবােধ কলায় হাত তােলে,
মাথা নত করে তার অতীত উপলে |

২| দ্রষ্টব্য

শরীর পুড়ছে ভীষণ গরমে শরীর পুড়ছে
বন্ধুরা তবু দ্রষ্টব্যের প্রত্ন খুঁড়ছে
দারুণ দু’বেলা উত্তেজনার সকল দিবস ,
মনটা আমার তাদের সঙ্গে সুদূরে উড়ছে ,
গা ঝেড়ে ওঠার মন করতেই শরীর বেবশ ।
বলে ঘরকুনো আমাকে নবীশি মহল-শুদ্ধ ।
তাই বিরুদ্ধ সময়ের সাথে করবো যুদ্ধ
বলতেই , ওরা ভীষণ শব্দে ধরলো খড়্গ —
একি ভালো ছেলে হচ্ছে হঠাৎ এমন লুদ্ধ !
ফাঁকি দিয়ে ওরা স্বর্গ খুঁজছে নগর-বর্গ ।
কেউ সতীর্থ সঙ্গিনী -সহ সুখের গন্ধ
খাচ্ছে আড়াল কামের কাঙাল কাতর অন্ধ –
মাছির মতন উড়ছে বেতাল ওদের মধ্যে ,
ভিনদেশিনীর মন যোগাচ্ছে বেহায়া ছন্দ ।
মাতাল রাত্রে গল্প শুনছি লোলুপ গদ্যে ।
সখ্যতা-হারা হাঁটছি যখন খুঁজছি সঙ্গ
চক্ষে আমার যুবতী নারীর নধর অঙ্গ
ঢেউ তোলে শুধু , ধু-ধু সংযম হয় বিপন্ন।
স্বপ্নে খুঁজছি বন্য নিবিড় গোপন রঙ্গ
হাঁটছি নগরে নীল বিহঙ্গ দেখার জন্য ।
শরীর পুড়ছে ভীষণ গরমে শরীর পুড়ছে
বন্ধুরা তাজা দ্রষ্টব্যের প্রত্ন খুঁড়ছে
উত্তেজনায় আহত দুষ্ট কামুক রক্ত
দেখার জিনিস ওই একটাই নগরে ঘুরছে
মুখোমুখি তার দাঁড়াতেই একি , শরীর শক্ত !
ভক্তরা বলে, এ অবরুদ্ধ বধির উষ্ণ
আদিম ইচ্ছা , রক্ত-লোলুপ জঙ্ঘা শিশ্ন–
পুরুষ-নারীর মুক্ত-সঙ্গম সরল যুক্তি ;
গহন জঘন গুহার ফাটল করছে প্রশ্ন —
পাবো কি তাতেই রক্তে আমার বিরল মুক্তি ?
ভীষণ গরমে শরীর পুড়ছে মিথ্যা-সত্যে
হইনি লিপ্ত কোনো গর্হিত কর্মে কথ্যে
মোহন দৃশ্যে ভাঙছি গড়ছি প্রেমের মূর্ত্তি ,
বংশ -তৃষ্ণা ডাকছে নিত্য দার-অপত্যে
ঢাকছে চিত্ত নগ্ন নতজানু ফতুর ফূর্ত্তি ।
উদর-পূর্তির আসব খুঁজতেই জীবন যাচ্ছে
সহজ স্বপ্ন রূঢ় বাস্তবে ধাক্কা খাচ্ছে
খুঁড়ছি তবুও সরল দৃশ্যে বিরল প্রত্ন —-
মগ্ন চক্ষে নগ্ন লক্ষ্মীর লক্ষ্য নাচছে ,
জ্বলছে এ-কোন্ আঁধার গুহায় প্রেমের রত্ন ?

৩| রাজধানী

রাজধানী এক্সপ্রেস ঢুকলো রাজধানী ।
চোখ জুড়ে নগরীর নব্য হাতছানি
মন জুড়ে মোহনার মগ্ন কানাকানি ।
ছুটে এলো একদল ভাড়াটে চালক
ধরতে পেরেছে ঠিক আনকোরা লোক ,
মানুষ কী ক’রে পায় শকুনের চোখ ?
আগন্তুক হিন্দিতে বড়ো নড়বড়া
এ শহরে হলো তার-ই প্রথম মহড়া
বাঙ্ময় হৃদয়ের হলো হাতকড়া ।
চড়া রোদ, ধরা গলা, জার্ণির ক্লেদ
সরল স্বপ্নের সাথে হলো বিচ্ছেদ,
এখানে মানতে হবে কতো কী নিষেধ !
এখানে রহস্য আছে যন্তরমন্তর
রামলীলা ময়দান সুস্থ গণতন্ত্রর
প্রতিবাদের মঞ্চ ,প্রপঞ্চে কুরঙ্গ
বিরোধীদেরকে মেরে করে ছত্রভঙ্গ ,
গান্ধীর সমাধিতে পুষ্পস্তবক
দিয়ে যান নেতাগুলো , নেপথ্যের ছক
নানা দর কষাকষি যুদ্ধ না শান্তি
কোনটা যে সমাধান ছড়ায় বিভ্রান্তি
কাশ্মীর কী যে প্যাঁচ গাল-ভরা দোস্তি
সীমান্তে লাগাতর বারুদের কুস্তি
উপত্যকার জনজীবন ভয়ানক স্তব্ধ
ধরপাকড় কারফিউ করবে কি জব্দ ?
সংসদে লেগে আছে কাদা ছোঁড়াছুড়ি
প্রকৃত বিতর্ক নাই ,শুধু গলাজোরি ,
অধিবেশনের দিন ক্রমসঙ্কুচিত–
এহেন গণতন্ত্র পেয়ে আমরা গর্বিত !
কমবেশি সব রাজনৈতিক দলই
ব্যবহার করে পেশীশক্তি বাহুবলী,
আইন বিচার আছে ,তবু সুবিচার
পায়না দুর্বল-শ্রেণী , জয় ক্ষমতার ।
চারিপাশে কানাঘুষো এন-আর-সি জুজু
সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গুজু
দ্যায় অনায়াসে সংসদে , ত্রাসে কাঁপে দেশ
নাগরিক দুর্গতির দায় দুঃখ ক্লেশ
নিজভূমে পরবাসী হওয়ার আশঙ্কা,
সমস্ত নস্যাৎ করে বিজয়ীর ডঙ্কা
লঙ্কা-কাণ্ড বাধে দেশে , দেঁতো হাসি হাসে
রাজধানী, মহতের বাণী বানে ভাসে !!

৪| নতুন দিল্লি ষ্টেশনে নেমে 

দু’ঘন্টা দেরী ক’রে দুপুর নাগাদ
পৌঁছলাম নতুন দিল্লি ষ্টেশনে, আড়ষ্ট অবসাদ
ঝেড়েঝুড়ে নামলাম ব্যাগ স্যুটকেস
নিয়ে, ধীরে সুস্থে পিছু যাওয়া পুরনো অভ্যেস ।
একনজরে দেখছি যে দিল্লি নগর—
রাজ পথে নেমে গেছে রেল -চত্বর
ব্যস্ত স্রোতের মতো মানুষের ভিড়ে
নানা যানবাহনের নকশী নিবিড়ে
যাত্রী ধরছে লাল কুর্তার কুলি
আশপাশ থেকে এলো ভিক্ষার ঝুলি ,
ছুটে এলো অটো ভ্যান ট্যাক্সি দালাল
ঠিকা দরে দিলো কতো বিপরীত চাল
এমন-কি ব্যাগ ধ’রে টেনে নিতে চায়
নবাগত যাত্রীরা বড়ো অসহায়
বোঁচকাবুঁচকি সহ কোনোক্রমে দ্রুত
অদূরের রাজপথে হন দ্রবীভূত।
বোঝা দায় কা’র কী যে কমিশন আছে–
হোটেলের নামধাম আওড়ায় কাছে
এসে কিছু লোক , দূর থেকে কিছু লোক
জনতার প্রতি হানে ঈগলের চোখ ,
পাঞ্জাবি-পাজামায় পাগড়ি ও দাড়ি-
ওয়ালা শিখ লোক দু’টো পার্ক করা গাড়ি
ঠেস দিয়ে হাতে খৈনি ছিলিম ডলে
একমনে, ডাকাতের মতো চোখ জ্বলে ;
ড্রাইভার বুঝি কিবা সন্ত্রাসবাদী
ইমতাম দৃষ্টিতে অর্থ বিবাদী।
একটি মারুতি লাল অতি আধুনিক
এসে ছেড়ে দিয়ে গেল রূপের বণিক
মহিলাকে, ফ্যাসানের দুরন্ত তাল
তুলে হেঁটে গেল পাশ দিয়ে উত্তাল
ঢেউ-তোলা ঊর্বশী-আগুনের আঁচ
চোখ দু’টো ব’নে গেল শো-কেসের কাঁচ,
ঝলসানো দুপুরের নির্মম ধার
হীরের ছোঁয়ায় যেন হলো চুরমার
পিছু ধায় অসংখ্য পুরুষের চোখ
ক’লজে নিঙড়ে নেয় রূপের আরক
বাতাসে বাজছে তার গমনের সুর,
এ ক্ষেত্রে কে-বা নয় পথের কুকুর ?
বিস্তৃত সীমানার বামপাশে বাস
ডান পাশে ছোট যান ছুটে হুসহাস
মাঝখানে ইটের রেলিং- ঘেরা লন
তাতে কিছু ফুলগাছ রচে আবেদন,
যানে ধায় জনস্রোত নগরীর বুকে
রৌদ্রে ধুঁকছি পোড়া পেট্রোল শুঁকে।
শব্দের ফুলঝুরি শুনি চৌদিকে
প্রধানতঃ অগম্য ভাষার নিরীখে
বুঝলাম বাঙালীর শতাংশ কম।
বন্ধুরা এগোবার নিলো উদ্যম।
আমার আকুল চোখে চলমান রীল
অগণিত দৃশ্যের ছবির মিছিল
কতোকিছু অভিনব দেখবার আছে,
দূরের পৃথিবী এলো দুয়ারের কাছে,
সাগরে অবগাহন হবে নিশ্চয়
মনের বিকাশ হবে , খুলবে হৃদয়।
পাবো কি সাক্ষাৎ তার ? যে আমার হবে
উদার হৃদয়-রানী মনে অনুভবে ?
কর্মযোগের সাথে এই ভাগ্যযোগ
জুটবে কি আদৌ আশু নিয়তি-অমোঘ ??
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।