।। বন্দে মাতরম ।। রম্য রচনায় বিদিশা ব্যানার্জি

একটি মেয়ের স্বাধীনতা

সোনালী দি বললেন কিছু লেখ, আমিও বলে দিলুম হ্যাঁ, লিখব। লিখতে বসে টের পেলাম বিষয় বস্তুটা যে সে নয়, সাক্ষাত স্বাধীনতা। থমকে গেলাম। লেখা আর বেরতেই চায় না। এ কি বিপাকে ফেললে “রগুবীর!!!
“এখন তুমিই ভরসা, রক্কে কর রগুবীর” বলে ঝুলে পরলাম।
দেখুন, স্বাধীনতা নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর প্যানর প্যানর করার লোকের অভাব নেই। এই আমার বাবাই কালকে আমাকে বল্লেন, “তোরা উচ্ছন্নে যাওয়া প্রজন্ম, তোরা স্বাধীনতার মর্ম কি বুঝবি?” গভীর প্রশ্ন, সত্যিই কি আমরা উচ্ছন্নে যাওয়া প্রজন্ম ? সকালে বাসে যেতে যেতে ভাবনাটা জাঁকিয়ে বসলো। আমার আবার যত গুরুগম্ভীর চিন্তা বাসে যেতে যেতে পায়। ব্যাগ জড়িয়ে চোখটা বুজলাম।
আমি একজন নিতান্ত সাধারন মেয়ে, তাই আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বাধীনতা কি, খায় না গায়ে মাখে সেটা ভাবতে শুরু করলাম। বাড়ি নিতান্ত মধ্যবিত্ত, মেয়ে-বউরা চাকরি করবার অনুমতি (!?) পেতেন না। চাকরি তো অনেক বড় ব্যাপার হয়ে গেল, মেয়ে কিভাবে ভাবনা চিন্তা করবে সেটাও বাড়ির পুরুষেরা ঠিক করে দিতেন। আমার একটি যমজ ভাই আছেন। তিনি বিদ্বান এবং আমাদের বাড়ির কূপমণ্ডুক চিন্তা ভাবনার থেকে মুক্ত পুরুষ। আমরা দুজনেই একসাথে বড় হয়েছি। ভাই গল্পের বই নিয়ে ভাববার এবং বই কিনবার ঢালাও অনুমতি প্রাপ্ত ছিলেন (এবং তিনি আমার সাথে সেগুলো নির্দ্বিধায় ভাগ করে নিতেন)। কিন্তু আমাকে বোঝান হত মেয়ে মানে পুজোতে পুতুল কিনে দেওয়া হবে এবং সেটা নিয়েই তুমি খুশি থাকবে। ভালো কথা। একটু বড় হলাম, রজস্বলা হওয়ার পরে কেড়ে নেওয়া হল পোশাকের স্বাধীনতা। গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা পোশাক পড়তে হবে। অন্য দিকে পড়াশুনো নিয়ে একটু এগোতে গিয়ে বাধা পেলাম, জানতে পারলাম মেয়ে মানুষ আবার এতো পড়াশুনো কি করবে? রুখে দাঁড়ালেন মাতৃদেবী। মাধ্যামিক পাশ করে বানিজ্য বিভাগ নিয়ে পড়াশুনো করার ইচ্ছে প্রকাশ করাতে জানতে পারলাম মেয়েদের কলা বিভাগ ছাড়া পড়ার স্বাধীনতা নেই। সেখানেও মাতৃদেবীর অনুপ্রেরনায় উতরে গেলাম। তার পরে এলো আরও কঠিন সমস্যা, আইন পড়তে বাড়ির বাইরে গিয়ে থাকা। বাড়িতে রীতিমত খণ্ডযুদ্ধ লেগে গেল!!!
বলাই বাহুল্য আমার ভাইকে কিন্তু এই নিয়ে কোন আপোশ করতে হয় নি।
আমি অত্যন্ত সাধারন মানুষ, আমার চাহিদাও নিতান্ত সামান্য। তাই আমার কাছে স্বাধীনতা মানে পুতুল কেনার পরিবর্তে টিনটিন পড়া,স্কার্টের দৈর্ঘ্য এক্টু ছোট হওয়া, কলা বিভাগ নয়, নিজের পছন্দ মত অঙ্ক নিয়ে পড়তে যাওয়া, উচ্ছন্নে না গিয়েও বাইরে থেকে ভালো ভাবে ডিগ্রি যে আমি নিতে পারি, বাড়ির লোকের এইটুকু ভরসা আদায় করা, এবং অবশ্যই আমি চাকরি করবো কিনা বা রোজগার করবো কিনা সেটার ব্যাপারে একমাত্র আমিই যে সিদ্ধান্ত নিতে পারি সেটা জগতের মেনে নেওয়া।
একটুখন আগেই আমার মায়ের কথা বললাম, সারা জীবন দেখলাম, “সংসারের হাঁড়ি ” ঠেলে গেলেনআর ৪৫-৫০ বছর বয়েস পর্যন্ত শুনে গেলেন বাপের বাড়ি থেকে কিছু শিখিয়ে পাঠায়নি। তাই আমার কাছে স্বাধীনতা মানে জাজমেনটাল মন থেকে মুক্তি যা দিয়ে আমাকে আমি হিসাবেই গ্রহন করতে পারব, আমার খুন্তি ঘোরানোর দক্ষতা দিয়ে আমার আমিত্বকে বিচার করব না। বা অন্য কেউ, আমি বিয়ে করলাম না কেন, বা আমি বিয়ে করার পরেও বাচ্চা নিলাম না কেন, সেই নিয়ে চুলচেরা বিচার করে আমাকে এক ঘরে করবে না।
আমি পেশাগত ভাব আইনজীবী। অনেক মেয়েকে দেখি এই অপমানজনক সামাজিক সেটআপ মেনে নিয়েছেন বিনা দ্বিধায়, তাঁদের বক্তব্য এটাই ভবিতব্য। তাঁরা অন্য দিকটা দেখতে নারাজ, পাছে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর জন্য কষ্ট করতে হয়। আমার কাছে স্বাধীনতা মানে আমি পরাধীন আর এটাই আমার ভবিতব্য এই চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া।
সময় অনেক পরিবর্তিত হয়েছে, এখন অনেক মেয়ে দক্ষতার সাথে সব দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের হয়ত পোশাক নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না বা আমার মত সামান্য কি বিষয় নিয়ে পড়বে সেটা নিয়ে বাড়িতে যুদ্ধ করতে হয় না। তারা হয়ত সব দিকে সমান দক্ষ, কিন্তু দিনের শেষে যখন ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে পরে, তখন কোন “সুপার ওমেন” তকমা কাজে লাগে না, মনে হয় কালকে যদি কেউ একবেলা রান্না করে মুখের সামনে ধরত তাহলে তার থেকে ভালো বোধহয় আর কিছু হত না। তাই আমার কাছে এটাও স্বাধীনতা যে “আমি সব পারি”এই ভাবতে ভাবতে শহীদ হয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলার থেকে মুক্তি।
হয়ত আরও অনেক ১৫ই আগস্ট কেটে যাবে এমন দিন দেখার আশায় , তবে আমি আশাবাদী আমি না পারলেও আমার কোন এক উত্তরসূরি, অন্য কোন এক বিদিশা সেই দিন দেখবে। ততদিন নাহয় দুপুরে জমিয়ে মাংস ভাত আর মাইকে “অ্যায় মেরে বতন কে লোগো চলুক”।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।