সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিশ্বজিৎ লায়েক (পর্ব – ১)

জন্মস্থান – পুরুলিয়া পেশা – সরকারি চাকরি প্রকাশিত কবিতা বই :- ১) ডানায় সে চুম্বকত্ব আছে ২) উন্মাদ অন্ধকারের ভিতর ৩) ভিতরে বাইরে ৪) পোড়া নক্ষত্রের কাঙাল ৫) মুসলপর্বের স্বরলিপি ৬) কৃষ্ণগহ্বর ৭) শরীরে সরীসৃপ ৮) প্রেমের কবিতা ৯) পোড়ামাটির ঈশ্বর ১০) ঈর্ষা ক্রোমোজোম উপন্যাস ১) কৃষ্ণগহ্বর

স্বর ও ব্যঞ্জনের পৃথিবী

আজকে মাত্র তিনটে। গতকালকেও চারটে ছিল। আগামীকাল যদি মাত্র দুটো হয়ে যায়, রাকা আর কাগজ কিনবে না। ধ্যাৎ দিন দিন কমে যাচ্ছে! পয়সা উসুল হচ্ছে না। কি আর করা যাবে। মনটা আকুপাকু করছে। বিড়ি ধরাল রাকা। জোরে জোরে বার দুই টান দিল। এখন প্রাণটা চা চা করছে। খুচরো নেই। একটা পাঁচশো টাকার নোট পড়ে আছে প্যান্টের পকেটের এক কোনে। সেই কবে থেকে আছে তো আছে। যেন পকেটের প্রেমে পড়ে গেছে রাকার পাঁচশো টাকার নোট। যেন জন্ম জন্মান্তরের মায়া!  নিতাইদা শালা ধার-বাকিতে বিস্কিট তো বহুত দূরের কথা এক কাপ চা ও দেবে না। আর পাঁচশোর ভাঙানিও দেবে না। যত শালা লাফড়া এই রাকার জীবনে! অন্য সকলের জীবন পাখির মতো ফুরফুরে।
রিন্টাদের পাড়া গেলে হয়। মোড়ের কাছে মাসিমার চায়ের দোকান। তোফা চা আর মুরগির ছাট মাংস দিয়ে ঘুঘনি  বানায়। মাসিমার মেয়ে তুলি। ক্লাস নাইনে পড়ে। রাকা ওকে হেবি লাইক করে। লাইক বলাটা বোধ হয় ঠিক নয়। লাইক তো সবাই ফেসবুকে করে। তবে কি ভালবাসা ! শব্দটা শুনলে রাকার কেমন যেন হাসি পায়। এমন হাসির জোয়ারে শালা কোনোদিন দম বন্ধ হয়ে নিজেই মরে যাবে। তা মরে গেলে চলবে না রাকার! কে দেখবে মাকে! মাঝে মাঝে নিজের উপর রাগ হয়। কিসের জন্য রাগ কিছুই বোঝে না। রাগ হলে রাকা চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে যায়। দূর! এটা কি বাথরুম! একপাশে দেওয়াল। অন্য তিনপাশে ছেঁড়া কালো পলিথিন শিট দিয়ে আড়াল করে কোনোমতে লজ্জা ঢেকে আরাম বোধ। লজ্জা আবার কী! ছাদ তো নেই। আকাশ দেখা যায়। সামনের ছাদে কোয়েল বউদি এলে দেখতে ইচ্ছে করে, হেবি দেখতে মাইরি। রুন্টা বলেছে হেবি দেখতে মানেই সিউর সেক্সি। রুন্টার বন্ধুরা আবার রাস্তায় মেয়ে দেখলেই সিটি মারে। রাকা সিটি মারতে পারে না। সিটি নাকি ছোটো থেকেই শিখতে হয়! রাকার শেখা হয়নি। অবশ্য সে নিয়ে রাকার কোনো দুঃখ নেই। রুন্টা আর তার বন্ধুরা মেয়ে দেখলেই এ ওকে ও তাকে ইশারায় দেখায়, দেখ দেখ কী মাল যাচ্ছে রে মাইরি! রাকা এইসব পারে না। কিন্তু সে দেখে। মেয়ে দেখতে তার ভালই লাগে। দেখে যে টুকু আনন্দ পায় তাতেও মাংসের ঝোলের মত স্বাদ। খাসির মাংসের এত দাম! কতদিন মাংসের ঝোল মেখে ভাত খায়নি রাকা। কেবল পোল্ট্রি আর পোল্ট্রি!
ধ্যাৎ তেরি সাড়ে নটা বেজে গেল। এখনও পেটে চা পড়ল না। মায়ের জন্য রুটি, ঘুঘনি নিয়ে যেতে হবে। তুলি স্কুলে যাচ্ছে। ওকে দেখলে রাকার বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। কতবার ভেবেছে প্রপোজ করবে। পারেনি। মোড়ের কালি মন্দিরে মা কালিকে বলেছে, ‘মা সাহস দাও।’  কিন্তু মা সে সাহস দেননি। এই তো কল্পতরু উৎসবে রামকৃষ্ণ মিশন গেছল। ঠাকুরকে জোড় হাত করে প্রণাম করল। কিন্তু একবারও বলতে পারল না, ঠাকুর আমাকে সাহস দাও। তুলিকে বলে দিই, আই লাভ ইউ। এখানে এলেই রাকা বিহ্বল হয়ে যায়। মন প্রাণ কেমন যেন ভরে ওঠে আনন্দে! তখন আর তুলিকে মনে পড়ে না। কোথায় যেন সে হারিয়ে যায়। কিন্তু সব ভুলে গেলেও রাকা খিদে ভুলতে পারে না। পেট চোঁচোঁ করে। যেন ভেতরে ইঁদুর লাফাচ্ছে, বিড়াল কীর্তন গাইছে! গরম খিঁচুড়ির গন্ধে আরো বেশি বেশি খিদে পায়। শেষে খিচুড়ি খেয়ে বাড়ি ফিরে রাকা দেখে মা তখনও খায়নি। মায়ের জন্য রাকার দরদ উথলে ওঠে। মা রাগ করে না। মা যেন সত্যি সত্যি ওই মিশন মন্দিরের মা সারদা!
কত দিন রাকা রাত করে ফেরে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে রাত দশটা বেজে যায়। খেয়ালই থাকে না। বাড়ি ফিরে দেখে তখনও মা জেগে। রাত করতে ইচ্ছে করে না। তবু দেরি হয়ে যায়। সে বুঝতেই পারে না কেন যে কখন কাকে ভাল লেগে যায়! আর কখন যে কেন কাউকেই ভাল লাগে না! মাঝে মাঝেই তার তাল কেটে যায়। নিজেকে সামলাতে পারে না। কখনও তুলিকে, কখনও মাকে, কখনও বন্ধুদের তার এন্তার ভাল লাগে। আবার কখনও কেবল নিজেকেই! কিন্তু মা কেন কিছু বলে না তাকে! কেন বলে না এত দেরি কিসের? মা কিছুই বলে না। সব কিছুই চেপেচুপেই  রাখে। ভিতরের বাইরের সব আঁধার, সব যাতনা।
তুলি যখন স্কুলে যায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে রাকা। দুজনেই দুজনকে দেখে। কেউ কারো সঙ্গেই কথা বলে না। তুলি হাসে। রাকাই হাসে। রাকার বন্ধুরা বলে, ‘মালটা তো চিকনি চামেলি রে ভাই! দু-একবার সাঁতার কেটেছিস তো!’
এইসব কথা এরা আগেও বলেছে। রাকা কিন্তু কোনো দিনই রাগ করেনি। আজ হঠাৎ মাথা গরম হয়ে উঠল।
-‘দেখ বাচ্চু মুখ খালি করবি না। শালা ভেজা গরম করাস না, বুঝলিয়া। নয়তো এক লাথ মারবো পাছায় ড্রেনে মুখ থুবড়ে গিয়ে পড়বি।’ রাকা কটমট করে তাকায় বাচ্চুর দিকে।
বাচ্চু হাসে। ঝকঝকে দাঁতে তার খৈনির বলাৎকার।বলে, ‘পিরিত যে উথলে উঠছে রে রাকা। মহাভারতের গল্প শুনিসনি – মেয়ে মানুষ ভাগ করে খেতে হয়। একা একা সহ্য হবে না। আর তুই না পারলে আমাকে ছেড়ে দে। রিফিউস করলেই রেপ।’

রাকা মুঠো শক্ত করে চোয়ালে চালিয়ে দেয়। বাচ্চু চোয়াল চেপে ছিটকে পড়ে রাস্তায়।

ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।