সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ১৬)

কু ঝিক ঝিক দিন

১৬.

সিঁথির বাড়িতে এক সকালে দেখলাম দোতলার জ্যেঠিমার আকুলিবিকুলি কান্না।জ্যেঠিমার সঙ্গে জ্যেঠুর ঝগড়া প্রায়ই লেগে থাকত।আর মধ্যস্থতা করতে মা কিংবা বাবা দৌড়তেন ওপরে। কিন্তু সেদিন দেখলাম কেউ গেল না।সারা সকাল এভাবেই গেল।আমার মাও দেখলাম গম্ভীর মুখ করে বসে।রান্না বান্নার দিকে তারও বিশেষ মন নেই।দুপুরে শুকনো মুখ করে নেমে এল সীমা। জ্যেঠিমার মেয়ে।কী হয়েছে, ফিসফিস করে জানতে চাইলাম । বড়দের ঝামেলায় থাকতে নেই, তাই এত গোপনীয়তা।
সে বলল, মহানায়ক মারা গেছে ।মা তাকে খুব ভালোবাসত।তাই আজ বাড়িতে রান্না বন্ধ। তারপর জানালো, বাবা অত বড় ইলিশ মাছ আনলো।মা রাঁধলো না।বাবা মার ওপর খুব রেগে গেছে।হলে হবে কী ! আজ আমাদের অরন্ধন।মাকে মাটি থেকে তোলা যাচ্ছে না।কেঁদেই যাচ্ছে ।
তখনো আমাদের বাড়িতে টিভি ছিল না।মহানায়ক সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না ।মাঝে মাঝে কানাঘুসো শুনতাম এর মুখে তার মুখে ।পাশের বাড়ির অমর জ্যেঠুদের উঠোনে নিশিপদ্ম বলে নাকি একটা সিনেমার সুটিং হয়েছিল ।সেখানে তিনি এসেছিলেন ।অনেকেই সেটা দেখতে আসত।আমার সেই ৬ বছরের চোখে তাতে নতুনত্ব কিছু ধরা পরেনি।কিন্তু সেদিন জানলাম উত্তম কুমার নামক এক মহানায়ক আছেন, যার মৃত্যুতে বাড়িতে রান্না হয় না।
জ্যেঠিমার মতো অনেকেই সেদিন সন্ধায় প্রদীপ জ্বালিয়েছিল, তাদের ঘরের মানুষের শোকে, আর ভালোবাসায়।
দিনটা ২৪ জুলাই ।মনের খাতায় ইতিহাসের সাল তারিখ মুখস্ত করে লেখার মত টুকে রাখলাম দিনটা।সালটা ১৯৮০।
অনেক পরে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার পর নেত্র সিনেমা হলে টানা একমাস ধরে উত্তম কুমার স্মরণে ২০ টা সিনেমা দেখেছিলাম আমি আর জ্যেঠিমা।আজও মনে আছে পরপর নামগুলো-দেয়া নেয়া,হারানো সুর,শাপমোচন,চিড়িয়াখানা ,নায়ক,খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন,বাঘ বন্দী খেলা,সপ্তপদী, থানা থেকে আসছি,মায়া মৃগ,ভ্রান্তিবিলাস,নিশিপদ্ম,সাহেব বিবি গোলাম, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি,বিচারক,সব্যসাচী,রাজলক্ষী ও শ্রীকান্ত।প্রতিটা আলাদা আলাদা চরিত্র।ভেবেছিলাম আহা, এ কী দেখিলাম।জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না যাহা দেখিলাম।সেই থেকে প্রেমে পড়ে গেলাম।যদিও ততদিনে চিরঞ্জিত,রঞ্জিত মল্লিক,প্রসেনজিৎ, তাপস পাল,অভিষেক এসে গেছেন।কিন্তু উত্তমের পাশে সব ফাঁকা। একটি করে সিনেমা দেখে এসে রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম ইস্ আমার জন্মটা কেন ষাটের দশকে হল না!তাহলে ঠিক কোনো না কোনো ভাবে একবার তার সঙ্গে দেখা করতামই।বাড়ি থেকে পালিয়ে তার বাড়ির আশেপাশে ঘুরতাম,যদি একবার সে দেখা দিত!আমার এক বন্ধু বলেছিল,তিনি নাকি মানুষ হিসেবেও খুব ভালো ছিলেন।যে যেত তার সঙ্গে নাকী কথা বলতেন।আর বাচ্চাদের তো ভালো বাসবেনই,কারন যে মানুষ বাচ্চাদের ভালো না বাসে সে কখনো এত বড় অভিনেতা হতে পারে না।
কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য সে আশা পূর্ণ হল না।তবে জীবনে একটি মাত্র অভিনেতার প্রেমেই পরেছি, বাকি সব ফিকে তার সেই লক্ষ পাওয়ারের হাসির সামনে।অমন করে কেউ শুধু তাকিয়েই হার্ট বিট বাড়িয়ে দিতে পারল না।
আমি আজও আফশোস করি বয়সটা যদি আরও বছর পনেরো বেশি হত!আর তখনি একমাত্র বাবা মার উপর রাগ হয়,কি দোষ ছিল বিয়েটা যদি আরও পনেরো বছর আগে করত!কিন্তু হায়!তখন তখন বাবারই বয়স হত ১৬আর মায়েরটা নাই বললাম…

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।