কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে এস মিয়া ওমরান (পর্ব – ৭)

মাছ

তাহের মাঝি খবর পাইছে খড়মা ওয়ালা বাড়িতে আসছে। খবর পাওয়ার সাথে সাথে ছুটে আসে তাকে ধরার জন্য। কিন্তু আসার পর তাকে আর পায়না।
সে মাঝে মাঝে বাড়িতে আসে গভীর রাত হলে।যখন চারদিকে রাতের নিরবতা নেমে আসে। তখন সে আসে। যেন মাঝি না জানতে পারে। তাই ধরা পড়ার ভয়ে চুপিচুপি বাড়ি আসে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তার বৌয়ের নাম ধরে ডাক দে।
একেবারে গলা নামিয়ে। যেন মুখের আওয়াজ বাড়ির বাহির না হয়। তার বউ প্রথম প্রথম টের করতে পারে না। দু’চোখে তার ঘুম টইটম্বুর কিন্তু কান জাগ্রত। সে অচেতন হয়ে শুয়ে রয়।ঘুমের ঘোরে কোন খোয়াব ন’ত।সে মনে মনে ভাবে। কারণ আজ সন্ধ্যা শোয়ার সময় তার কথা খুব মনে জপে ছিল। এ শিশির ঝরা নিশুতিরাতে যদি সে পাশে থাকতো।আরো কত কি ভাবনা তখন মনের ভেতরে উঁকি দিয়ে যায়। এভাবে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমে লুটিয়ে পড়ে সেও জানেনা।তারপর যখন চেতন আসে। তখন ভেতর থেকে সে জিজ্ঞেস করে।
কে?
আস্তে, আমি ।কয়েকবার বলে।
দরজা খুলো ।
দরজা খুলে তার স্ত্রী প্রদীপ জ্বলাতেই তা আবার সে সঙ্গে সঙ্গে নিবিয়ে দে।তাঁর মধ্যে সার্বক্ষণিক একটা ভীতি কাজ করে কখন কে দেখে মাঝিকে বলে দে।তারপর অন্ধকারে দুজন হারিয়ে যায় এক স্বপ্ন সুখের উল্লাসে। আবার রাত পোহাবার আগে আগে বাহির হয়ে যায়। যখন মোরগ ডাকে।যেন কেউ না দেখে। একদিন বাহির হতে দেরি হয়ে যায়। পথিমধ্যে দেখা হয়ে যায় পান্নু মিয়ার সাথে।তাকে দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। কারণ এ খবর নিমিষে মাঝির কানে চলে যাবে। আর গোপন থাকবে না। যার কাজ হল এলাকার কে কি করেছে তা বলিয়ে বেড়ানো। তাকে দেখলে সবাই বলে ঐ যে আসে খবরের ঝুলি।মাঝি এসে তাকে না পেয়ে তাঁর বউকে শাসিয়ে যায়। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে না আসলে তোমাকে নিয়ে যাব।
দোকানে খুব শোরগোলের শব্দ শোনা যায়। দূর থেকে তা ঝাপসা কানে আসে। তাহের মাঝি দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যায়। একজন বলে ও বদু পাগলা। সঙ্গে সঙ্গে মুন্সি আপত্তি জানায়।ভালো থাকতে ত বেশির ভাগ সময় আমার দোকানে আড্ডা দিত।একদিন খালি গায়ে আসছিল তখন আমি তার পিঠে একটা জন্মে দাগ দেখেছিলাম। সে আসার পর আমি জামা খুলে দেখেছিলাম ।কিন্তু পিঠে সেই দাগটা দেখি নাই ।উপস্থিত কেউ কেউ তার সাথে একাত্মতা পোষণ করে। তাহের মাঝি এতক্ষণ সব অবলোকন করল।তারপর বলে কেউ বলে বদু পাগল।কেউ বলে না। তাহলে তার স্ত্রী এ কয়েকদিন কার সাথে নিশিযাপন করে।দেশে কি মুন্সি-মাওলানা নাই। এত বড় জিনার কাজ হয়ে গেল। পরপুরুষ নিয়ে এতদিন ঘরে শুয়েছিল। দোকানে উপস্থিত সকলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থ হয়ে যায়। ছোট বড় একজন আরেক জনের মুখের দিকে চেয়ে রয়।আবার কেউ কেউ মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই।
বদু পাগলা এক সময় সুস্থ মানুষ ছিল। হঠাৎ করে আবোল তাবোল বকতে থাকে। এর কিছুদিন পর সে একদিন উধাও হয়ে যায়। এলাকার কোথাও আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়না । তার পরিবার পরিজন বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করে।
দেখতে দেখতে নয় দশ বছর হয়ে গেছে।তার কোন হদিস নেই। অনেকে তার আশা ছেড়ে দিয়েছে। হয়ত কোথাও গিয়ে মরে গেছে।
একদিন এলাকাতে খবর আসে বদু পাগলের দেখা পাইছে। বাংলাদেশের এক অপরুপ সৌন্দর্যে লীলাভূমি রাঙামাটিতে। বাড়ির পাশের এক লোক সেখানে চাকরি করতে গিয়ে তাকে দেখতে পায়।সেখানকার স্হানীয় বাজারে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বিড়বিড় করে বকে আর হাটে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে ‘দূর হ শয়তান ‘ বলে হাতের লাঠিটাকে পিস্তলের মতো করে গুলি করতে থাকে।
কখনো উপর দিকে ।
কখনো ডানে। আবার কখনো বামে আর মুখে শব্দ করে। দাড়ি-গোফে ঢেকে আছে তার মুখখানি । যখন তাকে নিয়ে আসতে চায় স্হানীয় লোকজন বাধা দেয়। তারা তাকে দিবে না। এ কয়েক বছর সে অনেকের মন জয় করে। কারণ সে কখন কোন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে নাই। দিলে খায়, না দিলে খায়না। কারো কাছে কোনকিছু জন্য হাতও পাতে না।
তাঁর স্ত্রী সামনে এসে বলে ও আমার স্বামী। তাকে নিতে আসছি। বহু জয়গা তাকে খুঁজেছি।
স্হানীয় সকলের কথা হল আমাদের এখানে অনেক মাথা নষ্ট লোক আসছিল কিন্তু ওর মত দেখিনি। নিয়ে আসার পর বেশিদিন স্হায়ী হয়নি। পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন থাকার পর আবার উধাও হয়ে যায়। তার স্ত্রী বহু চেষ্টা করেছে ভালোবাসার আঁচল দিয়ে তাকে বেঁধে রাখতে। তবু পারে নাই।
মনু মাঝি ইটের ভাটায় ঘুরে ঘুরে দেখতেছে অন্য মাঝিদের ইট কেমন হল।হঠাৎ তাহের মাঝির ইটের উঠানে এসে থমকে দাঁড়ায়। কাঁচা ইটের সারের মাঝে লাল শাড়ি পরে মেয়ে মানুষের মতো কে যেন এক ধ্যানে ইট বানিয়ে যাচ্ছে। সে অবাক চোখে তাকিয়ে রয়।কারণ এর আগে ইটের ভাটায় কোন মেয়ে মানুষ কাজ করে নাই। সঙ্গে ছিল তার লেবার হাসু।তার নাম ধরে বলে।
কিরে হাসু।
তাহের মাঝি আজকাল মেয়েলোক দিয়েও কি কাজ করাই। নরম হাতের ইট বুঝি ভালো হয়।শক্ত হাতে হয়না।
তাঁর খড়মা ওয়ালা পালিয়ে গেছে। তাই তার বউকে নিয়ে আসে কাজ করার জন্য।
তো রাতে মেয়েটা কোথায় থাকে?
সন্ধ্যা হলে কোম্পানির বাড়িতে চলে যায়। লেবার হাসু বলে। ইটের ভাটায় হইতে সামান্য দূরে হলো কোম্পানির বাড়ি।
আহারে..,মেয়েটির খুব কষ্ট হচ্ছে। তার জন্য মনু মাঝির খুব দরদ হয়।হাসু তুই কথা বল্ তার স্বামী মাঝির কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছে।আমি সব টাকা দিয়ে দিব।
হাসু প্রথমে মেয়েটার সাথে পরিচিত হয়।নানাবিধ কথাবার্তা বলে। তারপর আস্তে আস্তে মূল কথায় আসে। তোমার স্বামী কত টাকা নিয়েছে। কেন পালিয়ে যায়।
তার এ কাজ সহ্য হয় না।তাই পালিয়ে গেছে। হারামির বাচ্চার সহ্য না হলে কেন্ টাকা ধরল। প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে স্বামীকে গালি দে।আর মনে মনে কয়েকবার তার অমঙ্গল কামনা করে।
তার স্বামীর প্রতি এ ক্ষোভ দেখে হাসু আরো সুযোগ পায়।তখন সে তার মাঝির দেওয়া টাকার লোভ ছুড়ে দে । আমাদের মাঝি তোমাদের সব টাকা দিতে চায় । যদি সম্মতি থাক তাহলে তোমার স্বামীকে নিয়ে মনু মাঝির সাথে দেখা করো।
মেয়েটি চুপ করে রয় কোন কথা বলে না।হাসু চলে আসে তার কর্মস্থলে।
সে আসার পর মেয়েটিও ভাবে কাজটি তার কাছেও অনেক কষ্টের।কিছুদিন পর মেয়েটি তার স্বামীকে নিয়ে হাসুর কাছে উপস্থিত হ। হাসু তাদেরকে মনু মাঝির কাছে নিয়ে যায়। যখন সে তাদের দুঃখের গল্প শুনে তখন মনে হয় সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভদ্রলোক।
তারপর কোমর হতে টাকা বাহির করে তাদেরকে দে।মাঝিকে তার টাকা ফেরৎ দিয়ে আসো। আর তোমার কাজ হল ঘুরে-ফিরে দেখা কে কেমন কাজ করে। আর ইটের ভাটা উঠা পর্যন্ত এ সময় তোমার স্ত্রী আমার একটা পরিত্যক্ত বাড়ি আছে সেখানে থাকবে।
এর কিছুদিন পরে হঠাৎ একদিন মনু মাঝি এক ব্যাগ বাজার সাদাই নিয়ে আসে আর সাথে কিছু লোভনীয় পোশাক পরিচ্ছেদও ছিল। এ ধরো। বাজার সাদাইগুলো রাখ।আমি বেশ কয়েকদিনের জন্য ইটের ভাটায় যাচ্ছি। এ বলে সে বাহির হয়ে পড়ে। আবার কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে।
কি মাঝি চলে আসছেন যে?মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
তখন সে বলে, শরীরটা কেমন যানি দূর্বল লাগে। চলার শক্তি পাইনা। তাই ফিরে আসছি। তোমার ঘরে একটু ঘুমাব।মেয়েটি তার এ আবদারের বিরোধিতা করতে পারে না। কারণ তাঁর দান দক্ষিনা নিয়েছে।পেটে যে তারই দানাপানি। কিভাবে নিমকহারামি করে। এই বলে দুই দিন গত হয়ে যায়।আর এ সুযোগে মেয়েটির উপর সে তার অসৎ সাধনা হাসিল করে।
তাহের মাঝি এবং মনু মাঝির মধ্যে চরম চাপা ক্ষোভ চলছে। তাহের মাঝি নানান জনের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগও দিয়েছে। সে তার লেবারকে কুযুক্তি দিয়ে বের করে নিয়ে গেছে। আবার নিজে নিজে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও করে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আমিও সুযোগের অপেক্ষা আছি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।