সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ২৮)

কু ঝিক ঝিক দিন

২৮.

তারাপীঠ থেকে লোকজন আসা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মন্দিরের মূল পুজারী মুখার্জি জ্যেঠুর কথা।তিনি তার স্ত্রী ও অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে আসতেন কলকাতায়।আর থাকতেন আমাদের বাড়িতেই। একতলার একটা ঘর,রান্নাঘর, বাথরুম এগুলো তাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হত।
মেয়েটি তেমন কথা বলত না।মাঝে মাঝে কেঁদে উঠত।
জ্যেঠিমা চেষ্টা করতেন তাকে সামলাতে।আমি রোজই বাবার নির্দেশ মতো নিচে নেমে তাদের কি লাগবে না লাগবে তদারকি করে আসতাম।তখনি একদিন জ্যেঠিমা বলেছিলেন,মন্দিরের কেউ তাঁর মেয়েকে বাণ মেরেছে, তাঁদের ক্ষতি করার জন্য। মেয়েটাকে আমার পাগল করে দিল!
জ্যেঠিমা শাপশাপান্ত করত সেই বাণ মারা লোকটার উদ্দেশ্যে।হা হুতাশ করত।আর জ্যেঠু তখন রান্নাঘরে কুটনো কাটত।
এই বাণ মানে কি সেটা জানতাম না।নদীতে বান আসে,নির্দিষ্ট সময়ে, জোয়ার ভাটার একটা বিজ্ঞান সম্মত কারণ জানি।সমুদ্রের জল নদীতে মিশলে নদীর জল স্ফীত হয়ে বান আসে, এমনই পড়েছি।কিন্তু সেই বান মারা কি করে হয়!
আমাদের বাড়িতে কোনও রকম কুসংস্কার বা এমন কোনো কথা আলোচনা হত না,যা থেকে এইসব সম্পর্কে কিছুমাত্র ধারণা থাকতে পারে।
বাণ মানে আরেকটিও হয়।তীর ধনুকের বাণ,যা রামায়ন মহাভারত বা আগেকার দিনে যুদ্ধের অস্ত্র। সেই বাণ মেরেছে নিশ্চয়ই কেউ, তাই অসুস্থ এমন কিছু ভাবলাম।
কিন্তু তাতে তো আঘাতের চিহ্ন থাকবে।তেমন কিছু তো চোখে পড়ে না।অগত্যা হারুমামার শরণাপন্ন হলাম।
হারুমামা বাবার গ্রাম সম্পর্কে মামা,সে অর্থে আমাদের দাদু বলা উচিত। কিন্তু কখনো তা বলিনি।মামা বলেই ডাকতাম।মামা একতলাতেই আরেকটি ঘরে থাকতেন।আমার অনেক দুষ্টুমির ও বদমাইশির সাক্ষী এই মামা।
মামা বলল,বাণ গ্রামের দিকে কেউ কারোর ক্ষতি করতে চাইলে তার ওপর প্রয়োগ করে।এটা যারা তন্ত্র সাধনা করেন তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্য ব্যবহার করে।এতে মানুষের মঙ্গল না হয়ে ক্ষতি হয়।
শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।মানুষ মানুষের ক্ষতি চায়!তাদের খারাপ করার জন্য এসব করে!সে রাতে আমি আর ঝুম,আমার মেজবোন এই নিয়ে অনেক কথা আলোচনা করলাম। কোনো দিন কারোর ক্ষতি করব না ঠিক হল।
কিন্তু সে তো পরে হবে।এখন?এই দিদিটার কি হবে!যে ডাক্তার দেখছিলেন তিনি প্রতি দুমাস অন্তর দেখতেন। মা বলত,মেয়েটি কোনও কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। তোরাও আমাকে জ্বালিয়ে পাগল করে দিবি।তারপর কাঁদতে বসবি মায়ের কি হল বলে।
প্রথম কদিন তারা রান্না করে খেত।কিন্তু তারপর সেই মা’কেই করতে হত। মেয়েটি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ত,আর তার বাবা মা তাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে যেত।
প্রতিবার তারা চলে যাবার পর বাসন গুছিয়ে তোলার সময় দেখতাম কিছু না কিছু জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না।
একবার হারুমামা খেতে বসে বলল,যেমন চোর তেমন সাজা পাচ্ছে। পরের ক্ষতি করলে নিজেরই ক্ষতি হবে।মা সব দেখেন।
বাবা খুব রেগে গেল এই কথা শুনে। হারুমামাকে বকলেন।এমন কথা আপনার মুখ থেকে আশা করিনি।
হারুমামা বাবার মুখের উপর কোনো কথা বলতনা।
বাবা খাওয়া শেষ করে ঘরে ঢুকে যাবার পর মাকে বলল,বৌমা,ভাগনে যা করে করুক।সে সবাইকে বিশ্বাস করে।তুমি এত বাসন নিচে রেখো না।খালি যতটুকু দরকার,ততটুকু রেখো।
এরপর একবার তারা এসে টানা চার মাস থাকলো।তখন মেয়েটি একটু সুস্থ।
তারপর একদিন শুনলাম তার বিয়ে।বাবার থেকে টাকা পয়সা গয়না চাইল কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা।
এই ব্যাপারে বাবা ছিলেন মুক্ত হস্ত।কখনো কারোর চাওয়া অপূর্ণ রাখতেন না।ঠাকুমা যদি সামান্য কিছুও বলতেন,সাথে সাথে বাবা বলতেন,আমারও তিনটে মেয়ে।বাবা হয়ে আরেকজন মেয়ের বাবার পাশে দাঁড়ানো আমার কর্তব্য মা।তাতে আমার ভাগ কমে যাবে না।
ঠাকুমা আর কিছুই বলতেন না।
এরপর একবার তারাপীঠ গিয়ে তাদের বাড়ি গেলাম।দেখলাম সেই মেয়ে কোলে বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে। জ্যেঠিমা বলল,সবই কপাল।
সেই থেকে কপাল বিষয়টা কি বোঝার চেষ্টা চলছে…

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।