সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ২৭)

কু ঝিক ঝিক দিন

২৭.

নতুন বাড়িটায় এসে সব জিনিস নতুন গন্ধ মাখা হলেও মনটা কোথাও বসাতে অসুবিধা হচ্ছিল। পুরনো বাড়ি,কাকিমা,জ্যেঠিমা, বন্ধু এবং পাড়াটা… বিকেল হলেই কেমন মন খারাপ হয়ে যেত।এ পাড়ায় প্রথম দিকে কোনো বন্ধু হয়নি।আর আমাদের বয়সী কেউ ছিলোও না।স্কুল থেকে ফিরে তাই ছাদে অথবা সেই পুরনো পাড়ায়।
কিন্তু কোথাও একটা পরিবর্তন লক্ষ করতাম সেখানে। যখন ভাড়াটে ছিলাম তখন যেন লোকে অন্য চোখে দেখত।আর আজ! হঠাৎ করে যেন দেখার চোখ বদলে গেল।যে বাড়ি গুলোতে অবাধে আড্ডা দেওয়া যেত,এখন কেমন যেন দূরত্ব।
ফলে আসতে আসতে সেই পাড়ায় যাওয়া কমতে লাগল।নিরুপায় হয়ে নতুন বাড়ির উল্টো দিকে থাকা বয়স্ক জ্যেঠিমার সঙ্গে ডেকে ডেকে কথা বলতে শুরু করলাম।ক্রমশ তার ছোটো মেয়ে জয়া ওরফে জয়ীদির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।জয়ী বয়সে আমার থেকে বড়।কিন্তু দিদি বললে রেগে যেত।সাজতে ভীষণ ভালো বাসত।পায়ে আলতা দিয়ে নানা কারুকাজ করে পরত,চুল বাঁধত নানা স্টাইলে।আমিও আলতা পরতে ভালোবাসতাম নকসা করে।অধিকাংশ সময় সেই বলে যেত তার জীবনের গল্প।অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে মা কিভাবে তাদের চার ভাই বোনকে বড় করেছেন,দিদির বিয়ে দিয়েছেন, পড়াশোনা করতে ভালো লাগেনি বলে এইট অবধি পড়ে স্কুল যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে,এমনকি তার কাছেই প্রথম শুনেছিলাম সমকামী কথাটা।সে আর তার পরিচিত একটি মেয়ে, পরবর্তী কালে মেয়েটি নাচের জগতে প্রসিদ্ধ হয়,তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক আছে জানলাম।আমাকেও বলল,কিন্তু আমি শুনে ভয় পেয়ে গেলাম।অগত্যা তারা সম্পর্ক চালিয়ে গেলেও আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রয়ে গেল জয়ীর।
বয়ঃসন্ধীর সেই সময়টাতে নিজেকে কেমন অচেনা লাগছিল।এর মধ্যে বাড়ির একতলায় নিত্য নতুন লোকের ভিড়।কখনো তারাপীঠ থেকে পান্ডা আসেন তার মেয়ের চিকিৎসা করাতে তো কখনো কোনো তন্ত্র সাধকের দল।তারা দিন রাত গাঁজা আর মদ খায়,আর মা মা করে চিৎকার করে।রাত বাড়লে নেশার ঘোরে তাদের ভক্তি আরও বাড়ে।তখন সিদ্ধ লাভের জন্য তারা যে কি কি করে তা সচক্ষে দেখার জন্য রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে চুপিসারে নিচে নেমে কান পেতে তাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি।বুঝতে পারি ভেতরে কোনো আত্মা নামানো হচ্ছে। দৌড়ে ওপরে চলে আসি।কিন্তু আবার পরদিন যাই।সেদিন বন্ধ দরজার ভেতর থেকে অদ্ভুত সব মন্ত্র শুনি।
আমার বাবাও শ্মশানে দীর্ঘদিন সাধনা করতেন,আমিও তাঁর সঙ্গে কাটিয়েছি অনেক সময়।কিন্তু এমন মন্ত্র শুনিনি।কেমন একটা গা ছমছমে ব্যাপার।
এসবের মধ্যেই ঠাকুমা এলেন আজিমগঞ্জ থেকে।প্রথম কদিন কিছু বলিনি।তিনিও খুব একটা গুরূত্ব দেননি।আমি ঠাম্মার পাশেই শুতাম।একদিন রাতে ঠাম্মাকে বললাম।ঠাম্মা ছিল বন্ধুর মতো।তিনি শুনলেন।কিছু বললেন না।
পরদিন বাবা অফিস চলে যাবার পর হাতে ধরা রুপোর লাঠি নিয়ে আমাকে বললেন,ভাই আমাকে একটু ধরে নিচে নিয়ে যেতে পারবে?
মাতো ভয়েই অস্থির। ঠাম্মা নিচে গেছে জানলে বাবা কুরুক্ষেত্র করবে।তাছাড়া মা নিজেও সবসময় ভয়ে থাকতেন আমাদের নিয়ে। বাবা তো অধিকাংশ সময়ই বাইরে।এই সাধুদের ভাবগতিক ভালো ছিল না।মায়ের দিকে, আমাদের দিকে কেমন করে তাকাতো।
যাহোক,ঠাম্মার কথায় আমরা তিনবোন খুব খুশি। তাকে নিয়ে চললাম অভিযানে।ঠাম্মা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এক ধাক্কায় খুলে ফেললেন দরজা।ভেতরে তখন চিৎকার করে মা মা ধ্বনি। ঘর ধোঁয়ায় ভরতি।তার সঙ্গে কড়া গাঁজা আর মদের গন্ধ। এ গন্ধ শ্মশানে পেয়েছি বহুবার।তাই চেনা।
ঠাম্মা ঢুকেই বলল,এই শালারা এখানে কি করছিস?তখন ঠাম্মা কেই তারা নেশার ঘোরে বলছে দেবী তুমি দেখা দিলে,মা তুই দেখা দিলি! তোর চরণ দে মা।ঠাম্মা তখন রণ হুংকার ছেড়ে নিজের লাঠিটাকে ত্রিশুলের মতো ধরে বলছে,এক্ষুনি এ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যা।এখানে নেশা হচ্ছে? ভন্ড সাধুর দল,বেরো বলছি।
তারা বলে,মা এ তুই কি বলিস!বাবু আমাদের থাকতে দিয়েছে।
কে বাবু!কার বাবু?এটা আমার বাড়ি।
এবার তাদের নেশা কাটছে।তারা বলছে, কেন যাব! আমরা বেরিয়ে গেলে এ বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাবে।আমরা মায়ের সন্তান। শাপ দেব তোদের।
ঠাম্মা তখন মা দুর্গার মতো ত্রিশূল টা মাথার ওপর বনবন করে ঘুরিয়ে একেবারে একজনের বুকের ওপর চেপে ধরলেন।এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে না গেলে সবকটাকে বধ করব।
ঠাম্মাকে মনে হচ্ছিল সাক্ষাৎ মা দুর্গা।এখন চন্ডী রূপ ধরেছেন মহিষাসুর মর্দিনী হয়ে। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কি হতে চলেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা চলে আসবেন।যদি এসব দেখেন তাহলে যে কি হবে!অতিথিকে বিদায় তাও কিনা সাধকদের!
কিন্তু ঠাম্মার হুংকার দেখে তাদের শাপশাপান্ত ক্রমশ কমে এলো।তারা রাতটা থাকার জন্য কাকুতিমিনতি করতে লাগল।
অন্য দিকে চেনা ঠাম্মা তখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। যেন আজ অসুুর বধ করে তবেই শান্ত হবেন।
অবশেষে তারা আমাদের, মাকে শাপ দিতে দিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।ঘড়িতে তখন রাত দশটার ঢং ঢং শব্দ।
ঠাম্মা তার রণরঙ্গিণী রূপ ছেড়ে আবার স্বরূপ ধারণ করলেন।ওপরে এসে মাকে বললেন,বউমা কাল জমাদার ডেকে ঘরটা ভালো করে পরিস্কার করিয়ে নিও।আর আজ থেকে বলা রইল,কোনো সাধু দল বেঁধে এলে সেদিনই পত্র পাঠ বিদায় দেবে।
মা বলল,তাহলে আপনার ছেলেও আমাকে বিদায় দিয়ে দেবে।
ঠাম্মা বললেন,আমি কি মরে গেছি?তোমার বরটিকে তাদের সঙ্গে বের করে দেব।
সাড়ে এগারোটায় বাবা ঢুকে সব স্তব্ধ দেখে ওপরে এসে মাকে জিজ্ঞেস করল,ওনারা কোথায় গেলেন?
মা চুপ করে রইল।
ঠাম্মা বাবার গলা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,তাড়িয়ে দিয়েছি।
মা,ওনাদের আমি আসতে বলেছিলাম। ওরা সাধক।
ঠাম্মা বললেন, আর আমার বাড়ি।আমি চলে যেতে বলেছি।অনেক রাত হয়েছে, খেয়ে নিয়ে শুতে যাও।বউমাকে সকাল বেলা উঠতে হয়।অনন্ত কাল তোমার জন্য না খেয়ে অপেক্ষা করতে পারবে না।
বাবা মুখ গম্ভীর করে ঘরে চলে গেল।স্নান পুজো সেরে মায়ের সঙ্গে একটাও কথা না বলে খেয়ে শুয়ে পড়ল।
পরদিন ঠাম্মা সকাল বেলায় বাবা বেরবার সময় জোরে জোরে বললেন,বউমা জমাদার কখন আসবে?আবর্জনা পরিস্কার করা দরকার।
এরপর বাবা আর এ বিষয়ে কথা বলেনি।তবে তারাপীঠ থেকে বা রাজ্যের অন্য প্রান্ত থেকে লোক আসা বন্ধ হল না।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।