কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ছিলেন দেশের প্রথম মহিলা চিকিৎসক।উনবিংশ শতকের ভারতীয় রক্ষণশীল সমাজের গোঁড়ামিকে তোয়াক্কা না করে চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষিত হয়ে নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। তিনি যে শুধু দেশের প্রথম মহিলা চিকিৎসক তা নয়।তিনি ছিলেন দেশের প্রথম মহিলা স্নাতক ডিগ্রী অর্জনকারী দুজনের মধ্যে একজন।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর জন্ম ১৮৬১ সালে বিহারের ভাগলপুরে।তাঁর পৈর্তৃক বাসস্থান বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালের চাঁদসি গ্ৰামে।তাঁর পিতা ব্রজকিশোর বসু ছিলেন পেশায় একজন শিক্ষক।তিনি বিহারের ভাগলপুর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।তিনি চাকুরী সূত্রে ভাগলপুরে থাকতেন।সেখানেই কাদম্বিনীর জন্ম।
কাদম্বিনীর বাবা ব্রজকিশোর ছিলেন নারীশিক্ষা আন্দোলনের সমর্থক।তিনি ও অভয়চরণ মল্লিক ভাগলপুরে মহিলাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছেন।তারা ভগলপুরে নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য মহিলা সমিতি স্থাপন করেছিলেন।তিনি চেয়েছিলেন নিজের মেয়েকে পড়িয়ে উচ্ছ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন ।এই স্বপ্ন নিয়ে তিনি কাদম্বিনীকে স্কুলে ভর্তি করে দিন। ১৮৭৭ সালে কাদম্বিনী এন্ট্রেন্স পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এবং ১৮৭৮ সালে কাদম্বিনী এন্ট্রেন্স পরীক্ষায় সুনামের সঙ্গে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।তারপর তিনি বেথুন কলেজে ভর্তি হন।১৯৮২ সালে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী স্নাতক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং কৃতিত্বের সাথে বি,এ পাশ করেন।তখন তাঁকে বাংলার প্রথম গ্ৰ্যাজুয়েট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন তিনি মেডিকেলে পড়বেন।পিতার সন্মতিতে তিনি ১৮৮৩ সালে মেডিকেল কলেজ ভর্তি হন।ঐ বছরই মেডিকেল কলেজের সুনামধন্য শিক্ষক দ্বারকাননাথ গাঙ্গুলী সাথে তার বিবাহ হয়।দ্বারকাননাথ ছিলেন বিপত্নীক কিন্তু তাদের বিবাহিত জীবনে কোন অশান্তি হয়নি বরং বিবাহিত জীবনে সুখী হয়েছিলেন তারা।বিয়ের পর স্বামীর অনুপ্রেরণায় প্রবল ইচ্ছা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন কাদম্বিনী।মেডিকেলের ছাত্রী হিসেবে সেসময় তিনি কুড়ি টাকা বৃত্তি পেয়েছিলেন।১৮৮৬ সালে তিনি মেডিকেলের লিখিত সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ব্যবহারিক পরীক্ষার একটি অপরিহার্য বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন।কিন্তু কতৃপক্ষ তাঁর দীর্ঘদিনের অধ্যয়ন-পরিশ্রম ও নিষ্ঠার কথা বিবেচনা করে গ্ৰ্যাজুয়েট অব বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ(জেবিএমসি) ডিগ্ৰী প্রদান করে।এই ডিগ্ৰী লাভের পর হন তিনিই প্রথম ডিগ্ৰী ধারী ভারতীয় মহিলা চিকিৎসক। ১৮৮৮ সালে
তিনশত টাকা বেতনে লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে যোগদান করেন।এরপর ১৮৯৩ সালে মেডিকেল আর উচ্ছশিক্ষা লাভের জন্য এডিনবার্গে যান।সেখানে সফলতার সঙ্গে শিক্ষা সমাপ্ত করে দেশ ফিরে আসেন। বিদেশ থেকে তিন তিনটি ডিগ্ৰী অর্জন করেছিলেন তিনি।পরবর্তীকালে আজীবন তিনি চিকিৎসক হিসেবে মানুষের সেবা করে গেছেন।
কাদম্বিনীর এই সফালত সেই সময় এতটা সহজ ছিল না।তৎকালীন রক্ষনশীল সমাজে নারীশিক্ষা ও নারীস্বাধীন খুব নিন্দনীয় ছিল।সেসময়ের কুসংস্কারপন্থী গোঁড়া সমাজপতিরা কাদম্বিনীর এই সফলতা নিয়ে এতটাই অসন্তুষ্ট ছিল যে তারা তাঁকে ও তার স্বামীকে নিয়ে অনেক কুরুচিকর মন্তব্য করেছিল।বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশচন্দ্র পাল তাঁকে হেয় করে একটি কার্টুন প্রকাশিত করেছিলেন।তাতে দেখানো হয়েছিল কাদম্বিনী তাঁর স্বামী দ্বারকাননাথ গাঙ্গুলীর নাকে দড়ি বেঁধে টেনি নিয়ে যাচ্ছেন।তার নিচে লেখা ছিল কাদম্বিনীকে নিয়ে অত্যন্ত কুরুচিকর মন্তব্য।মহেশচন্দ্র পালের এহেন অসভ্যতামিকে মোটেও প্রশ্রয় দেননি কাদম্বিনী ও তাঁর স্বামী।তারা মহেন্দ্র চন্দ্রের বিরোদ্ধে আদলতে মানহানির মামলা করেছিলেন।আদালতের রায়ে মহেশচন্দ্রের ছয় মাসের জেল ও একশো টাকা জরিমানা হয়েছিল।এছাড়াও মেডিকেল পড়ার সময় মেডিকেল কলেজের গোঁড়া শিক্ষকরা তার বিরোধিতা করতে থাকেন।এমনকি তাঁকে মেটেরিয়া মেডিকা ও তুলনামূলক শরীরবিদ্যা বিষয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেল করে দেওয়া হয়।
১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বুম্বে অধিবেশনে প্রথম যে ছয়জন নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন কাদম্বিনী ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম একজন।পরের বছর কংগ্রেসের কলকাতায় ষষ্ঠতম অধিবেশনে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন।তিনি ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা।তিনি গান্ধিজীর সহকর্মী হেনরী পুলক প্রতিষ্ঠিত টি.আই.এ (ট্রানওভার ইণ্ডিয়ান অ্যাসোশিয়শনের প্রথম সভানেত্রী ছিলেন।এছাড়া তিনি ১৯১৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ব্রহ্ম সমাজের অধিবেশনের সভাপতিত্বের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া কাদম্বিনী নারী অধিকার আদায় আন্দোলনের সোচ্ছার ছিলেন। ১৯২২ সালে তদানীন্তন ভারত সরকার কাদম্বিনীকে বিহাড় ও উড়িষ্যার নারী শ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য প্রতিনিধি হিসেবে নিযোক্ত করেছিল।
১৯২৩ সালের ২রা অক্টোবর সেনিব্রার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী মৃত্যুবরণ করেন।তিনি ছিলেন দেশের প্রথম নারী চিকিৎসক ও স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রথম ভারতীয় মহিলা।পরবর্তীকালে তাঁর অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক মেয়ে উচ্ছ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলন।শুধু উচ্ছ শিক্ষিত নয় , অনেকে মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠাতাও পেয়েছিলেন।তিনি আজো ভারতীয় নারীর কাছে এক মহান আদর্শ।