সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিজয়া দেব (অন্তিম পর্ব)

অতিমারী
সাধারণ মানুষ জানল ভাইরাসের চরিত্রবদলের কথা। মিউটেশন অফ ভাইরাস সম্পর্কে একটা ধারণা হল। সার্স কোবিড 2 ভাইরাস বা কোবিড নাইন্টিন তার চরিত্র বদল করে হয়েছে ডেল্টা ভাইরাস। মানুষ শুনতে পেল আরেকটা ঢেউ আসবে অর্থাৎ তৃতীয় ঢেউ সেই ভ্যারিয়েন্ট এর নাম ওমিক্রন। সেটা কি ডেল্টার মত ভয়ংকর হবে আগাম বলা যাচ্ছে না। তার আক্রমণাত্মক চেহারার অভিঘাত দেখার পরই বোঝা যাবে, সুতরাং মানুষকে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। সংক্রমণ যাতে না ছড়িয়ে পড়ে তার জন্যে মুখে লাগাতে হবে মাস্ক, হাত জীবাণুমুক্ত করতে হবে বারবার হয় স্যানিটাইজার নয় সাবানজল দিয়ে। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এসব নির্দেশাবলী কারা ঠিকঠাক পালন করতে পারবে? প্রথম বিশ্বের দেশগুলো। তৃতীয় বিশ্বের মত গরীব দেশে সেটা কি সম্ভব?”
প্রত্যাশা এসেছিল। বিপাশাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেছে যে সে যথেষ্ট সাবধানে থাকে। তারপরও যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আর কী করার আছে! কেন দিল্লিতে মানুষ মরে নি? খুব সাবধানে ঘরে থেকেও মানুষ মরে নি? হ্যাঁ, অবশ্যই সাবধানে থাকতে হবে তবু আকস্মিকতা যেহেতু আছে সেটাকেও বুঝে নিতে হবে।
মরমী এখন একা, সম্পূর্ণ একা… হয়ত একদিন তাকে একা হতেই হত, কারোর বাবা মা শেষপর্যন্ত থাকেন না। তবু এই আচমকা মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না, কিছুতেই না। মায়ের মৃত্যুর জন্যে কি সে-ই দায়ী? যা অবিরাম তাকে করা হচ্ছে। করছে বৃন্দা ও নিরাময.. মাকেও ভ্যাকসিন নেওয়ানো হয়েছিল, একসাথেই বাড়ির সবাই নিয়েছে।
এই বিশাল পৃথিবীতে মরমীর আর কে আছে একান্ত আপনজন! কেউ নেই। অবশ্য মানুষ বরাবরই একা। এখনের ছবি তাই তো বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে। পৃথিবী ধুঁকছে, ধুঁকছে মানুষ… একা একা চলে যাচ্ছে মানুষ.. পুড়ে ছাই হচ্ছে…. কবরস্থ হচ্ছে… একা একা… একা একা… ভাইরাস বুঝিয়ে দিল, এটাই তো জীবনের গূঢ় রূপ… মহাশূন্যতা….
এই সবুজ প্রকৃতির আপাত সবুজের মাঝে সক্রিয় হয়ে আছে লালচোখো ভাইরাস.. বারবার নিজের চরিত্র বদল করছে… সে প্রাকৃতিক না কী মানবসৃষ্ট তা নিয়ে নিয়তই প্রশ্ন উঠছে।
এক অগাধ শূন্যতা চারপাশে। অগ্নি স্বপ্নিল কথাকলি কাজ করছে। মায়ের প্রতি যাবতীয় শাস্ত্রীয় কাজ শেষ করে মরমীও নেমে পড়েছে কাজে। অগ্নি ও স্বপ্নিল অনুভব করছে মরমী ও কথাকলি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করলে অনেকটাই মনোবল আসে, আসে অতল ভালোলাগা।
১৩
ধীরে ওষুধ হাসপাতাল সিটের অপ্রতুলতা অক্সিজেন – সংকট কিছুটা বাগে আনা হল। মানে সংক্রমণের মাত্রা কিছুটা কমলো, অক্সিজেনের যোগান বাড়ল খানিকটা। ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হল, দ্বিতীয় ডোজ। সবাই বলছে করোনা ভাইরাস তার চরিত্র বদল করছে। সার্স 2 থেকে বেশি ভয়ংকর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। তৃতীয় ঢেউ এ নাকি আসবে ওমিক্রন। কেউ বলছে ওটা আরও ভয়ঙ্কর, কেউ বলছে চরিত্র বদল করতে করতে ভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়ে। কত কথা ভাসছে বাতাসে। কিছু সত্যি কিছু গুজব। আসলে এধরণের বিশ্বব্যাপী অতিমারির কোনও অস্তিত্বের প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় নি। এই ভাইরাস আবার সবার প্রাণ নিচ্ছে না। এমন নয় যে শুধু বয়স্ক রোগাক্রান্তরাই মারা যাচ্ছে। রীতিমত যুবাবয়েসি শক্তসামর্থ ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মী অধ্যাপক ইস্কুলশিক্ষক কিংবা বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত মানুষ হঠাৎ মারা পড়ছেন আবার নব্বই বছরের বৃদ্ধ করোনা জয় করে সবার হাততালি অভিবাদন পেতে পেতে বাড়ি ফিরছেন। ব্যাপারটা একটুখানি দুর্বোধ্য জটিল বৈকি। গোটা ব্যাপারটাই যেন একটা বিশাল না মেলানো অঙ্ক। অগ্নি একা একা বসে এসব ভাবে। সেবিকার চলে যাওয়া এমন আকস্মিক যে মোটেই বিশ্বাস করা যায় না সে নেই। সে সুচিকিৎসক ছিল। গতকাল হাসপাতালে এক রোগিনী এসে সেবিকার খোঁজ করছিল। সেবিকার পেশেন্ট। দুঃসংবাদ শুনে কী কান্না। মরমীও খুব একা। মাকে হারিয়েছে মাসি মেশোকে হারিয়েছে। বাড়িতে নিরাময় ও বৃন্দা তাকে অভিযুক্ত করছে মায়ের মৃত্যুর জন্যে। মরমীকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারলে ওরা বেঁচে যায়। মরমীর দিশেহারা অবস্থা। অগ্নি বোঝে আর্থিক দিক দিয়ে মরমী একদম ভালো নেই। পার্লার বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কী নিয়ে বাঁচবে সে! শুধু এন জি ও – র কাজ নিয়ে কী বাঁচা যায়! পথশিশুদের ইস্কুলটাও তো বন্ধ।
সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে এখন অগ্নি ভয় পায়। মরমী তার চাইতেও বেশি। এ ক’দিনে কাজকর্মে একসাথে বসে কথা বলে বলে এটুকু বুঝে গেছে অগ্নি। সত্যিই তো খুব কষ্ট দিয়েছে সে মরমীকে। তাছাড়া এই সময়টা বড় কৃপণ, শুধু বেঁচে আছি এই শর্তেই যেন বেঁচে থাকা, এর বেশি এক পা এগোবার জো নেই। এদিকে অণুজীব নামক গুপ্তঘাতক ঘাপটি মেরে আছে, কখন কাকে ছিনিয়ে নেবে কে জানে! মরমীকে হাসপাতালে কোনও চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মরমী কি রাজি হবে? জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে। এই অতিমারিতে অনেক লোক পেশা বদল করেছে। তাদের পাড়ার তনুশ্রী মেয়েটি, যে সাইবার কাফেতে অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করত সে ও তার শারীরিক প্রতিবন্ধী বাবা মিলে একটা মুদিখানা খুলেছে। বাড়ি বাড়ি হোম ডেলিভারি দিচ্ছে। বেশ চলছে। মরমীকে হাসপাতালে চাকরির প্রস্তাবটা দেওয়া যেতে পারে। ক্লারিক্যালে পোস্টে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারবে অগ্নি। তবে মরমী তার হাসপাতালে কাজ করতে চাইবে কিনা সে একটা প্রশ্ন বটে।
সরকারি সাহায্য নেই, ডোনেসন এখন আদায় করা মুশকিল। পলাশ এসে একদিন সাহায্য চাইল। স্বপ্নিল ও কথাকলি কিছু সাহায্য করেছে, মরমী নিজের এই পরিস্থিতিতেও কিছু সাহায্য করেছে। পলাশের ঘরবাড়ির ভালোমন্দ অবস্থার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল অগ্নি।
পলাশ বলে – আমরা তো সবসময় এরকমই বাঁচি ডাক্তারবাবু। ঝড়তুফান অসুখবিসুখ এসব নিত্যিদিনের সঙ্গী। একটা কথা বলব? কী জানি কী ভাববেন! নিজের কাছের মানুষ মরে গেলে আমাদের কষ্ট হয়, আবার হয়ও না। হ্যাঁ, কেউ চলে গেলে কান্নাকাটি করি, তবে মনে হয় বেঁচে যখন ছিল তখনই বা কী সুখে ছিল!
দ্বিতীয় ঢেউ থিতিয়ে পড়েছে। গভীর ক্লান্তি, ভয়ানক দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে মানুষ আবার বাঁচে। একটু মোড় ঘুরেই বাঁচে… এবার আগমন ঘটবে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এর। তৃতীয় ঢেউ। এখন মাঝখানের এই ফাঁকটুকুতে যতটুকু পারা যায় সুস্থ আনন্দের খোঁজে মানুষ বেড়াতে যায়। মাঝ ডিসেম্বরে ডা.অগ্নি, মরমী, স্বপ্নিল, কথাকলি, পলাশ আকাশ তারাদের নিয়ে বেড়াতে গেল পুরীর সমুদ্রে। হ্যাঁ মানুষ আছে.. সমুদ্রস্নানে সববয়সের লোকজনদের দেখা যাচ্ছে। উত্তাল ঢেউয়ের ভেতর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে অনেকটা ঢেউয়ের ঝাপটের ভেতর চলে গেছে অগ্নিরা। জীবন আজও সফেন হয়ে আছে।