সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ১২)

গ্যাস চেম্বার

পর্ব – ১২

১২ই নভেম্বর
– তুই টিপিকাল হাউস ওয়াইফ হয়ে যাচ্ছিস জানিস? তােকে কোথাও একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে । রণজয় বলল আমায়। – আমি এখন চাকরি করতে পারব না। আমার কি এখন চাকরি করার স্টেজ? ডেলিভারি হােক। বাচ্চা বড় হােক, তারপর । – তাহলে তুই এত দুশ্চিন্তা করিস না । প্লিজ। – দুশ্চিন্তা কি এমনি করছি। তুমি কী কাজ করাে কিছু বলাে না । কোত্থেকে টাকা আসবে জানি না । দুশ্চিন্তা হবে না? রণজয় আমার দিকে তাকাল, তুই তাে একবারও জিজ্ঞেস করিস না কবে আমরা বিয়ে করব? রেজিস্ট্রি কবে হবে? – আমি সেসব নিয়ে চিন্তিত নই । যখন নিয়ে এসেছ, তখন তুমি আমায় ফেলবে না, আমি জানি । – এত বিশ্বাস আমার ওপর? তাহলে এই বিশ্বাসটুকুও রাখ তােকে আর আমাদের বাচ্চাকে আমি খাওয়াতে পারব । – কীভাবে খাওয়াবে? আমার খুব টেনশন হচ্ছে । তুমি তাে কিছু করাে না ।
– আমার কিছু করার দরকার পড়ে না। আমি আবৃত্তি করি । যে শব্দ তােকে আমার কাছে এনে দিয়েছে সেই শব্দ বলার চর্চা করি। অবশ্য তুই যেভাবে মাথা খাচ্ছিস তাতে চর্চা-চৰ্চা চুলােয় গেছে। একটা নতুন সিডির পরিকল্পনা হচ্ছিল কিন্তু… – সে সব পরে হবে। আগে বাবা হও, তারপর । এখন বলাে, আবৃত্তির বাইরে কী করাে?
রণজয় সেদিন আমার কোলে ওর ল্যাপটপটা তুলে দিয়ে বলল, দ্যাখ কীভাবে শেয়ার কেনাবেচা করতে হয় । এই যে একশাে টাকার একটা শেয়ার আমি কিনছি, এবার যদি এটা একশাে চার টাকায় ওঠে বিক্রি হয়ে যাবে। আবার এই শেয়ারটার দামই যদি নিরানব্বই টাকায় নামে তাহলেও তৎক্ষণাৎ ওটা বিক্রি হয়ে যাবে । মানে আমি ম্যাক্সিমাম লস করলে এক টাকা করব, আর ম্যাক্সিমাম লাভ করলে চার টাকা। এবার, চার টাকা আর এক টাকা মানে কিন্তু চার টাকা আর একটাকা না । আমি হয়তাে হাজার শোর কিনেছি। কোনােদিন চার হাজার টাকা লাভ হতে পারে, কোনােদিন পাঁচশাে টাকা লােকসানও হতে পারে । বুঝলি কিছু ? – বুঝলাম । কিন্তু এত অনিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করে চলা যায়? – আরে এটাই একমাত্র রােজগার নয় রে। এর বাইরেও টাকা আছে।
কত আছে? দুলাখ? পাঁচ লাখ? – তাের কত হলে শান্তি হয়? – তুমি বলাে কত আছে? দশ? কুড়ি? – এক কোটির ওপর আছে । শান্তি হল? – এক কোটি? বাজে কথা ।
একদম ঠিক কথা । – কী করে পেলে? – এই শেয়ার থেকেই পেয়েছি । – শেয়ার বেচে এক কোটি? – ইউনিয়ন কারবাইডের নাম শুনেছিস তাে? কোম্পানিটা একদম ধুলােয় মিশে গিয়েছিল। আমার বাবার সঙ্গে একজন ব্যবসা করত, সে বাবার অনেক টাকা ফেরত দিতে পারেনি, তাই আড়াই হাজার শেয়ার দিয়েছিল ইউনিয়ন কারবাইডের । সেই শেয়ারগুলাের তখন বাজারে দাম ষাট বা সত্তর টাকা। তার পরে কোম্পানিটা হঠাৎ করে ঘুরে দাঁড়াল, টার্ন অ্যারাউন্ড হল যাকে বলে । তখন ওই এক একটা শেয়ার’এর দাম দাঁড়াল আঠাশশাে -উনত্রিশশাে টাকা ।
তখনই আমি পঞ্চাশ-ষাট লাখ টাকা রােজগার করেছি এক দাঁওয়ে । সে আজ থেকে প্রায় ষােল-সতেরাে বছর আগের ঘটনা। তারপর ওই টাকাটাই বিভিন্ন জায়গায় ইনভেস্ট করে, আজ যে জায়গায় এসেছি তাতে, নিশ্চিন্ত থাক, জীবনে কষ্ট করতে হবে না আর ।
ইউনিয়ন কারবাইড! নামটা হালকা করে আমার মাথায় বেজে উঠল একবার ।
– কোম্পানিটা কোথায় ছিল যেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
– তুই জানিস না, ওই যে ভূপালে গ্যাস ট্র্যাজেডিটা ঘটল, অনেক লােক মারা গেল? ওদের কারখানাতেই তাে হয়েছিল সেটা। ভূপালেই প্ল্যান্ট ছিল ওদের। রণজ্য বলল।
ভূপাল! বড়মামা থাকত শহরটায় । যেখানে রাস্তায় অজস্র পঙ্গু, অসুস্থ, নিশ্বাস নিতে না পারা সব লােকজন … যেখানে একদিনে হাজার হাজার লােক মারা গিযেছিল! বড়মামি বলত, এটা একটা মৃত্যুপুরী। এখানে বাতাসে বিষ। সেই বাতাস, সেই বিষ, সেই গ্যাস ট্র্যাজেডি, তার সঙ্গে টাকার, শেয়ারের কী সম্পর্ক? কী সম্পর্ক তার সঙ্গে রনজয়ের? আমার? আমাদের ভালােবাসার? আমাদের দুজনের ভালােবাসায় যে আসছে তার?
৩রা ডিসেম্বর
ইউনিয়ন কারবাইড । ডিসেম্বর মাসের কত যেন একটা তারিখ, কী যেন একটা সাল? আমার মনে পড়ল না। তখন আমি খুব ছােট। মামার বাড়িতে গিয়েছিলাম। আর মামি খালি গল্প বলত দু’বছর আগের সেই রাত্রির । বড়মামা চাকরি করত মধ্যপ্রদেশ গভর্নমেন্টে। ট্যুর সেরে ফিরছিল সে রাত্রে । যদি ট্রেন থেকে নামত তাহলে স্টেশনেই মৃত্যু হত বড়মামার । যেমন মৃত্যু হয়েছিল হাজার হাজার লােকের, ওই কারখানা থেকে বয়ে আসা বিষাক্ত বাতাসে । সেদিন রাতে ভূপালের মেইন স্টেশনে যারা যারা নেমেছিল প্রায় সবারই মৃত্যু হয়েছিল । কিন্তু এক আশ্চর্য দক্ষতায় ট্রেনটাকে ওই সময়ে স্টেশনে প্রায় থাকতেই দেয়নি স্টেশন মাস্টার । ট্রেন থেমেছিল মুহূর্তের জন্য আর তার পরেই এগিয়ে গিয়েছিল। প্রাণ বেঁচে গিয়েছিল অনেকের।
আমি সেই গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি। আর ভেবেছি যারা নেমেছিল, যারা মরে গেল, তারা কারা? একটা রাক্ষসের মতাে গল্পগুলাে আমার কাছে এসেছিল | সেই রাক্ষস, একমাত্র একা একটা ঘরে বন্দী হয়ে থাকলে, যার সঙ্গে দেখা হয় । সবার সঙ্গে থাকলে, আলাে জ্বললে, যে রাক্ষসের কথা মনেই পড়ে না । জীবন হতাে সেই আলাে জ্বলা ঘরটা, জীবন সবার সঙ্গে থাকাটা, কিন্তু রনজযের মুখ থেকে শােনা ওই একটা কথা, আমার মধ্যে সেই অন্ধকার ঘরটাকে আবার জাগিয়ে তুলল। রাক্ষসটাকে ফিরিয়ে আনল । আমরা বেঁচে আছি, আমরা ভালাে আছি, আমরা ঘুরতে যাচ্ছি, সব কিছু ওই বিষাক্ত গ্যাসের পয়সায়!
আমি রণজয়কে আমার ভাবনাগুলাে বললাম কয়েকদিন পর । কিন্তু রণজয় হেসেই উড়িয়ে দিল, দুর্ঘটনা ইজ দুর্ঘটনা । কত কারণে কত লােক মারা যায়। দাঙ্গা-ফাসাদ, বন্যা, খরা কত কিছুতে লােক মরে । এটা সেরকমই একটা ঘটনা। এর সঙ্গে আমাদের কি যােগ? আমি যখন অামেরিকা গিয়েছিলাম, তখন ম্যানহাটানে দেখেছি পঞ্চাশ না বাহান্ন তলা অফিস এই ইউনিয়ন কারবাইডের । বিশাল এক প্রাসাদ। ওই বাড়িটা তাে কেউ ক্রেন দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়নি কই। দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে । – অ্যামেরিকায় ওদের কারখানা আছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম । – হ্যাঁ, আছে তাে। ওদের হেড অফিস চার্লেসটন বলে একটা জায়গায় । – কিন্তু সেখানে বােধহয় সেফটি স্ট্যান্ডার্ডটা অন্যরকম, তাই না? – এখানেও সেফটি স্ট্যান্ডার্ডটা অন্যরকম ছিল । ইন্ডিয়ানরা কিছু মানে না। কিছু বােঝে না । রণজয় বলল । অতটা উদাসীনতার সঙ্গে কীভাবে কথা বলছিল রণজ্য? এই রণজয়কে তাে আমি চিনি না । যে আমাকে পার্কস্ট্রিট থেকে প্রায় উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল নিজের বাড়িতে, কোনােরকম কোনাে প্রশ্ন না করে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিল, সে অত লােকের মৃত্যু সম্পর্কে এত ক্যাজুয়ালি কথা বলছে কী করে! আমি আবার বললাম, এত মানুষের মৃত্যু, এত মানুষের দীর্ঘশ্বাস সব কিছু জড়িয়ে থাকবে আমাদের জীবনের সঙ্গে? – তিনশােবছর আগের বুড়িদের মতাে কথা বলিস না । মরে যাওয়া মানুষের কোনাে দীর্ঘশ্বাস থাকে না। বেঁচে থাকা মানুষের থাকে ।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।