T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় ব্রততী

হার
খুশিকে প্রথম দেখেছিল মন্দিরপাড়ার বাজারে। তৃণারা তখন এদিকে সবেই এসেছে। পুরনো পাড়া ছেড়ে এই আধা গ্রাম্য পরিবেশে আসবার সময় একটু যে মনখারাপ হয়নি এমন নয়। তবে মানিয়ে নিয়েছে। এখানকার শান্ত নির্জনতার একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল।
মিশাকে সকাল সাতটায় স্কুল বাসে তুলতে যাওয়ার সময় এরপর অনেকবারই দেখেছে খুশিকে। অপরিণত অপুষ্ট কিম্ভূত শরীর। কোটরে ঢোকা চোখ দুটোতে কেমন যেন ভাষাহীন দৃষ্টি। ফাটা ঠোঁটে মাখামাখি হয়ে লেগে আছে জেবড়া বোকাটে হাসি। আলখাল্লার মতো পোশাক, বিবর্ণ মলিন দুর্গন্ধযুক্ত। স্থানীয় দোকানগুলিতে মাসির দোকানের চা দিয়ে বেড়ানোই ছিল ওর সেই সময়ের কাজ। হাসিমুখে কাজ করে বেড়াত খুশি। চোখ সরিয়ে নিত তৃণা। ওকে দেখলেই কী একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেত তার সমস্ত অন্তর। সঙ্গে সঙ্গেই মনের আয়নায় ভেসে উঠত হুইলচেয়ারে আধশোয়া মিশার লালাঝরা মুখ, অর্থহীন হাসি, চলৎশক্তিহীন ক্ষীণ শরীর, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ! নিজের অজান্তে আপন মনেই আত্মজর সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে খুশিকেই জিতে যেতে দেখে ঈর্ষার আগুনে দগ্ধ হয়ে যেত তৃণা নামের অসহায় এক মাতৃহৃদয়। আগুন নিভে এলে দুচোখ ভিজে উঠত অপরাধবোধে। এসব কী ভাবছে সে! ভাবনার এ কী কদর্য সংকীর্ণতা। অথচ প্রতিবারই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
কোভিড পরিস্থিতিতে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেল মিশার স্কুল। এরপর অনেকদিন আর খুশিকে দেখতে পায়নি তৃণা। ভুলেও গিয়েছিল ওর কথা। হঠাৎ একদিন কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দেখে কাঁদো কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে আছে খুশি। চেহারা যেন কঙ্কাল । চোখদুটো যেন আরো কোটরাগত। হাউমাউ করে জানালো এই কোভিডের জন্য ওর সব কাজ চলে গেছে। প্রায়দিনই হয় না খেয়ে নয়তো আধপেটা খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে। তৃণা যদি মিশার সব কাজ আর অন্যান্য সব কাজের জন্য ওকে রাখে! প্রশ্নই নেই! শামুকের মতো খোলের মধ্যে গুটিয়ে গেল তৃণার মনের সব উদারতা কোমলতা। ক্রুর নিষ্ঠুরতা খেলে গেল মস্তিষ্কের কোষে কোষে। বিরস মুখে বলল, “উপায় নেই গো! এই অবস্থায় বাইরের মানুষ ঘরে ঢোকাতে পারব না। বুঝতেই তো পারছ বাচ্চা আছে ঘরে!” এরপরও কিছুক্ষণ কাকুতি মিনতি করেছিল খুশি। বরফ গলেনি। ফিরে গিয়েছিল সে, ফ্যাকাশে মলিন মুখ আরো ফ্যাকাশে করে, চোয়াল ঝুলিয়ে। এরপর আবার বয়ে গেছে দিন। তৃণার মন থেকেও ধীরে ধীরে মুছে গেছে ঘটনার জের।
কোভিড কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর দীর্ঘদিন পর আজ আবার মিশাকে স্কুলবাসে তুলতে এসে গেটকিপার বিট্টুদার মুখে তৃণা খবর পেল খুশি তার হাসিখুশি মুখটা নিয়ে মরজগতের মায়া কাটিয়েছে একমাস হলো। তৃণা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওর পা দুটো যেন কেউ মাটির সাথে গেঁথে দিয়েছে। ঘামতে ঘামতে জ্ঞান হারালো সে।
নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে একদৃষ্টে জানলার দিকে তাকিয়ে ছিল তৃণা! দুপুরের একফালি রোদ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওর চোখ মুখ গাল। তন্ময় হয়ে ভাবছিল এবারেও জিতে গেল খুশি! কী হবে মিশার! একা অসহায় এই নির্দয় সংসারে! মিশার বর্তমান অবস্থার কোনো উন্নতি তো সম্ভব নয়ই বরং দিনে দিনে আরো অবনতির আশঙ্কা জানার পর মা হয়ে যে মুক্তি ও নিয়ত চেয়েছে সন্তানের জন্য সেখানেও খুশিই জিতে নিল বিজয়ের সিলমোহর। অথচ আজ আর তৃণার মনে কোনো রাগ নেই ঈর্ষা নেই ঘৃণা নেই খুশির প্রতি। আর দৃষ্টি ভেসে যাচ্ছে অনেক দূরে! যেন ছুঁতে চাইছে অনিশ্চিত অজানা অদেখা এক ভবিষ্যতের পাতায় লেখা তার অসহায় সন্তানের ভাগ্যলিপি! আর হলুদ রোদের ওমে দুচোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে শুধু এক ভেঙে চুরমার মাতৃহদয়।