মেহেফিল -এ- কিসসা আদিল সাদ (বই নিয়ে আলোচনা)

‘একাত্তরের ফার্স্টবয়’ উপন্যাসে স্বাধীনতার
চেতনায় গণমানুষের প্রেক্ষাপট লিপিবদ্ধ

কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম জুয়েলের লেখা একটি সৃজনশীল ও সার্বজনীন উপন্যাস একাত্তরের ফার্স্টবয়। এই কথাসাহিত্যিককে আমি কখনও চিনতাম না, গত বইমেলার আগে তার সাথে পরিচয়। মানুষ হিসাবে অত্যন্ত সৃজনশীল, লেখার মানের বিচার করলে বলতে হবে বাংলাদেশে যে ক’জন বর্তমানে উপন্যাস বা কথাসাহিত্যের উপর লিখতেছে, তাকে সে কাতারে বিচার করলে কোন সমালোচনা হবে না। একাত্তরের ফার্স্টবয়টা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে লেখা। সামাজিক একটি যুদ্ধকালীন উপন্যাস। এখানে ফুটে উঠেছে হাহাকার, অত্যাচার, নির্যাতন আর বিষাদের আটকে থাকা কোন রোমান্টিক চরিত্র। ফুটে উঠেছে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ভাষণের প্রেক্ষাপট। কোন মায়ের বলা বীর সন্তানের প্রতিবাদ করার স্বপ্ন। তুলে এনেছেন পরিবারের একজন মা কীভাবে সন্তানকে বিপ্লবী হতে সাহায্য করে, স্বপ্ন দেখায়,দেশপ্রেম শেখায়। এই উপন্যাসে আমাদের সমাজে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মায়েদের বিশাল ভূমিকা সম্পর্কে তিনি আলোকপাত করেছেন। বিশেষ করে কয়েকটি চরিত্র আলোচনা না করলে ভুল হবে। একটি ছোট মেয়ের প্রবাসী জীবন। দেশপ্রেমের স্বাদ নেওয়ার গল্প তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন, এক কথায় অসাধারণ। পিংকি নামক ছোট মেয়ের চরিত্র ও কথা সংলাপে যে কোন কিশোর–কিশোরী তার দেশপ্রেমকে মনের গভীরে লালন করবে। বিশেষ করে এই উপন্যাসের নায়ক দুর্জয় যেভাবে তার মায়ের কথা শুনে বঙ্গবন্ধুর চেতনা লালন করে এদেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, তার ভালোবাসার চিত্র প্রতিটা লেখায় তিনি ফুটে তুলেছেন। দুর্জয়ের অসাধারণ প্রতিভা, বয়ঃসন্ধিকালের বন্ধুত্বের যে প্রেক্ষাপটে জাফর, মোবারক, ফারুক, মামুনের সংলাপগুলো ও চরিত্রগুলো এই বইটিতে ফুটে উঠেছে, তা না পড়লে বোঝা যাবে না। একটি মানুষের প্রতিভা বা শক্তি কখনও আটকে রাখা যায় না। বিপ্লবীরা কখনও পরাজিত হয় না। বিদ্রোহীরা কখনো মাথা পেতে অন্যায় সহ্য করে না। তার প্রধান আকর্ষণ এই উপন্যাসটি। এখানে ফুটে উঠেছে হ্রদ নামে একটি কিশোরদের সামাজিক সংগঠন, যার প্রধান কাজ রহস্য অনুসন্ধান করা। এই অনুসন্ধানমূলক কাজের ফলে শেষ পর্যন্ত দুর্জয়ের প্রিয় বন্ধু জাফরের কাছে একাত্তরে লেখা মূল্যবান একটি ডায়রি পৌঁছে যায়। যুদ্ধের দীর্ঘ সময় পরেও, জাফর সাহেব তার বীর মুক্তিযোদ্ধা দুর্জয় নামক বন্ধুর সন্ধান পায়। দুর্জয় একজন স্বাধীনচেতা মানুষ। যার সংগ্রাম, দেশপ্রেম এদেশের মানুষদের কাছে গৌরবের। উপন্যাসে ফুটে উঠেছে ভালোবাসার একটি চরিত্র, যার নাম শান্তা। যে নীরব ঘাতককে হত্যা করতে বিপ্লবী চেতনা ধারণ করে। দুর্জয় নামক ছেলেরা আমাদের দেশে সব সময় জন্ম নেবে, স্বাধীনতা ধরে রাখবে, ক্ষুদিরাম হবে, বিপ্লবী হবে। শান্তার চরিত্রটি এখানে এমন একটি সত্ত্বা ধারণ করে, যে উপন্যাসটি না পড়বে সে বুঝতে পারবে না। এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিত একটি মেয়ে শান্তা। যে দেশের জন্য সব ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ করেছে, নিজেকে যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে। সর্বশেষে স্বাধীনতার প্রতীক রক্ষা করতে বিসর্জন দিয়েছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব। লেখক এখানে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এদেশে নীরব ঘাতক বেঈমান, মীরজাফরে রক্তের পরিচয়ের বহন করা হান্নান আকন নামের এক রাজাকারকে। য্এে দেশের একজন নারী বীরকে মিথ্যা পরিচয়ে বিয়ে করে স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে আসছিল। শান্তা তার পরিচয় জানার পর নিজের স্বামীর অস্তিত্ব ভুলে দেশের সন্মান বাঁচাতে ক্ষুদিরামের মতন হত্যা করে, দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মশুদ্ধি করেছেন নিজের অস্তিত্বকে। নিজেকে পুড়িয়ে শুকিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন দেশের উপারে কিছু নেই। ছোট্ট মেয়ে পিংকির সংলাপ এদেশের কিশোর-কিশোরীর মনে নতুন দেশপ্রেম চর্চার সঞ্চালক হবে। এই উপন্যাসে রাজাকাররা যে এখনও দেশের নানা স্থানে সম্মানের সাথে বেঁচে আছে তা লেখক চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।

তার লেখার বিশেষ গুণ আলাদাভাবে আলোচনা করতেই হবে। তিনি কিছু কিছু জায়গায় ভালো উপমা সৃষ্টি করছেন। শব্দের কিছু ভালো ব্যবহার এনেছেন। যেমন- কৃত্রিম রাগ, ন্যাওটা, বুক ধড়ফড়ানি, অপরাজেয় স্কুলজীবন, অর্ধমৃত, চৈতন্যহীন; আরো নানা শব্দের সমাহার তুলে নিয়ে এসেছেন।

তবে বিশেষ করে আরেকটু রোমান্টিকতা দিলে ভালো হতো কারণ দুর্জয়ের ভালোবাসার মানুষ হিসাবে শান্তা চরিত্রটির সাথে তার সংলাপ হলে আরেকটু প্রফুল্ল ভাব চলে আসত।

এই উপন্যাসটি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে পড়ে আমার কাছে সার্বিকভাবে সমৃদ্ধ মনে হয়ছে। এই উপন্যাসটি গণমানুষের জন্য, কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটি ভালো মানের বই হিসাবে আমার কাছে মূল্যায়ণ পেয়েছে। লেখকের উত্তরীয় সাফল্য কামনা করছি। আরও সমৃদ্ধ উপন্যাস পাঠককে উপহার দিক।

বইয়ের নাম : একাত্তরের ফার্স্টবয় (কিশোর উপন্যাস) লেখক : সাইফুল ইসলাম জুয়েল
প্রকাশনা : পরিবার পাবলিকেশন্স প্রচ্ছদ : আইয়ুর আলআমিন পৃষ্ঠা : ৮৬, মূল্য : ২০০ টাকা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।