পৌষ-পার্বণ উৎসবে অনিন্দিতা শাসমল

ফিরে দেখা আশ্চর্য পৌষ !

(মনে প’ড়ে গেল এক রূপকথা ঢের আগেকার,
কহিলাম ,– শোনো তবে—
–জীবনানন্দ দাশ)
রূপকথাই বটে ! আজ ঝাঁ চকচকে শহরের সাজানো বাড়িতে বসে যখন ফিরে যাই আমার জন্মভূমি, আমার প্রিয় গ্রামের সেই মিষ্টি মধুর দিনগুলোয়,মনে মনে বলে উঠি —
“ঐটি আমার গ্রাম– আমার স্বর্গপুরী
ঐখানেতে হৃদয় আমার গেছে চুরি।”
পৌষ পার্বন– গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে এক আনন্দ উৎসব।হেমন্তের শেষে , সোনালী ধান যখন মাঠে মাঠে হাসি ছড়ায়,তখন থেকেই এই উৎসবের সানাই বাজতে শুরু করে। একসময় সেই সোনালী ফসল কাটা হয়।আদিগন্ত মাঠকে রিক্ত নিঃস্ব করে , কৃষকের মুখ হাসিতে ভরিয়ে খামারে আসে সেই ধান।পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে গৃহস্থের উঠোন বা খামার এবং ধান ঝাড়াই করার পরে– ধানের গোলা বা ধান রাখার ঘর ,যা অনেক জায়গায় হামার বা মরাই নামে পরিচিত। মাঠ থেকে ধান আনার সময় এক গোছা আমন ধান মাথায় করে এনে, আলাদা ভাবে রেখে দেওয়া হয়।সংক্রান্তির আগের দিন বাউনি বাঁধা হয়। খড়ের গোছায় তেল স়িঁদুর মাখিয়ে প্রদীপ ও শঙ্খধ্বনি সহযোগে মাটির উনুন , ধানের বস্তার ও গোলার ওপর দিয়ে পুজো করে ,তারপর চালগুঁড়ো দিয়ে পিঠে বানানো শুরু হয়। বাউনির আগের সারাদিন ধরে মা — ঠাকুমারা ঢেঁকিতে পা দিয়ে চালের গুঁড়ো তৈরী করে রাখত।আমরাও বায়না করতাম,ঢেঁকিতে পা দেওয়ার বা ঢেঁকির মুখের সামনের গর্তে হাত দিয়ে (খুব সাবধানে হাত না দিলে যে কোনো মুহূর্তে বিপদের সম্ভাবনা) গোটা ও ভাঙা চালের মিশ্রণ ওলটপালট করার জন‍্য।
পৌষ সংক্রান্তির দিন ঐ মাঠ থেকে আনা আলাদা করে রাখা ধানের আঁটি ও ধান চালা, কুলো ,সের ইত্যাদি কিছু চাষের সরঞ্জাম রেখে খামার পুজো হয়।অনেক গ্রামে এটিই লক্ষ্মীপুজো নামে সুপরিচিত।আর এই পুজোকে ঘিরেই পালিত হয় গ্রামের মকর সংক্রান্তি ,যার মূল আকর্ষণ হল চালের গুঁড়ো,দুধ,ছোটো ছোটো করে কাটা বিভিন্ন ফল,নারকেল কোরা ,ঘি ও মধু দিয়ে তৈরী এক সুস্বাদু তরল খাদ‍্য — মকর, সঙ্গে নানান ধরনের পিঠে।খামারে ধানের গোলা থেকে যেখানে ধানের আঁটি রাখা হয় পুজোর জন‍্য,সেই পর্যন্ত গোবরজলে নিকোনো পরিষ্কার উঠোনে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ এঁকে দিত মা বা ঠাকুমা।
পরবর্তীকালে ,একটু বড় হওয়ার পর ঐ দায়িত্ব এসে পড়ে আমার ওপর।অপটু হাতেই সুন্দর করে খামারে রাখা ধানের আঁটি,যাকে লক্ষ্মীরূপে পুজো করা হত ,তার চারদিকে গোল দাগ কেটে দাগ বরাবর খড় দিয়ে ; দাগের ভেতরে চাষের সব সরঞ্জাম ,যেমন– জোড়া গরু,লাঙ্গল, মই, সের, মান,ধামা,কুলো,ধান ঝাড়ার পাটাতন,গরুর গাড়ি ইত্যাদি আঁকতাম।সঙ্গে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ।
পাশাপাশি অবস্থিত দুটো খড়ের গাদার মাঝখানটায় একটু উঁচুতে খড় দিয়ে ছাউনি তৈরী করে সব ভাইবোনেরা মিলে বানাতাম কুঁড়েঘর।নীচে মোটা মোটা কয়েকটি বস্তা দিয়ে বেশ গদির মতো বিছানা তৈরী।সন্ধে হলেই মা জ‍্যেঠিমা বা ঠাকুমার হাতে বানানো গুড়পিঠে,আসকে পিঠে,সরুচাকলি ,নারকেল,তিল বা বাঁধাকপির পুর দিয়ে তৈরী ভাপাপিঠে, মুগপুলি ,পাটিসাপটা ইত্যাদি বাটিতে করে এনে, ঐ কুঁড়েঘরের গরমের আরামে বসে ভাগ করে আনন্দভোজন ! আর বাবা বাইরে খামারে,রাতে লক্ষ্মীপুজো হওয়ার আগে অব্দি, কাঁসার ঘটিতে জল নিয়ে বসে থাকত — দূর থেকে কখন একটা শেয়াল ডেকে উঠবে — সেই আশায় কান পেতে। পিঠে খেতে খেতে আমাদের কানও খাড়া থাকতো।শেয়ালের ডাক শুনলেই , ঐ কাঁসার ঘটিতে ভর্তি করে রাখা পুকুরের জল,আমার হাতে আঁকা গোল দাগের বাইরে ছড়িয়ে দিত তিনবার।একে বলা হত “সার ধরা”।শেয়ালের নাম উচ্চারণ করা বারণ ছিল ঐ দিন।ডাক শুনে আমরা কুঁড়েঘরের ভেতর থেকেই শাঁখ ,কাঁসর ঘন্টা বাজাতাম।আশেপাশের যারা শুনতো,সব বাড়িতেই শাঁখ,কাঁসর ঘন্টা বেজে উঠতো।
কখনো পাড়ার কিছু বদ ছেলে ,দূর থেকে হুক্কা হুয়া বলে শেয়ালের ডাক নকল করত।বাবা বুঝতে না পেরে জল ছড়াতে গেলেই ,আমরা হৈ হৈ করে উঠতাম নকল ডাক বলে।বাবা বকলে বলতাম,আমরা ঠিক বুঝেছি এটা নকল ,কারণ আমরাও যে মাঝে মাঝে এই বদমাইশি করতাম বাবা কোনো কারণে বাড়ির ভেতরে ঢুকলে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন গ্রামে এই লক্ষ্মীপুজো সংক্রান্তির দিন না হয়ে পরের দিন অর্থাৎ ১ লা মাঘ হয়ে থাকে।মকর পরব বা পৌষ পার্বনের আরও কিছু অঙ্গ
হল টুসু উৎসব,মোরগ লড়াই এবং স্থানীয় মেলা ।
পৌষ সংক্রান্তির দিন ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে টুসু দেবীকে বাঁশ বা কাঠের তৈরী রঙিন কাগজে সাজানো চৌডল বা চতুর্দোলায় বসিয়ে কাছাকাছি নদী বা পুকুরে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দিয়ে , স্নান করে নতুন বস্ত্র পরে।
রাঢ় বাংলা বিশেষত বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন নদী ও জলাশয় রঙিন হয়ে ওঠে টুসু ঠাকুরের বিসর্জনের পর।লোকজীবনের সুখ দুঃখ হাসি কান্না নিয়ে, ভিন্ন সুর,কথা ও ছন্দে ভেসে আসে টুসু গান—
” যা যা টুসু যা লো
দেখা গেছে তোর পিরিত লো
তোর পিরিতে মন মানে না,
বলি তোর পিরিতে আগুন জ্বলেনা …”
অথবা,
“এমন জাড় (শীত ) ভাই দেখি নাই আগে
গেল বুড়াবুড়ির দাঁত লাইগে
টুসু হামার জাড়ের গ‍্যাঁদাফুল
মকর সিনান করে বাঁধব চুল..”
টুসু পরব আসলে একটি লোক উৎসব ,যা অগ্রহায়ণ মাসের শেষদিনে শুরু হয় আর শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তির পুণ‍্যলগ্নে।টুসু এক লৌকিক দেবী যাকে কুমারী হিসেবে কল্পনা করা হয় বলে ,
সাধারণত কুমারী মেয়েরাই টুসুপুজো করে।অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তি থেকে সারা পৌষ মাস ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটি পাত্রে রাখা চালগুঁড়ো, তুষ ,গোবরের মন্ড,আতপ চাল ,গ়া়ঁদা ফুল ইত্যাদি রেখে পাত্রের গায়ে হলুদ লাগিয়ে তাকে চিঁড়ে,মুড়ি, গুড় ,বাতাসা, ছোলা সহযোগে ভোগ নিবেদন করে টুসুদেবী রূপে পুজো করে মেয়েরা।
সংক্রান্তির আগের দিন সারারাত ধরে ,কুমোরের তৈরী হলুদ রঙের মাটির অশ্ববাহিনী বা ময়ূরবাহিনী টুসুমুর্তিকে একই ভোগ নিবেদন করে পুজো করে এবং সারারাত ধরে চলে টুসু গান।পরের দিন ভোরে টুসুর বিসর্জন হয় নদী বা পুকুরে।বাঁকুড়া,পুরুলিয়ায় প্রায় সকলেই এই টুসু পরবে মাতলেও ,পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বিশেষ কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই পরব সীমাবদ্ধ।
পৌষ পার্বনের আর একটি আকর্ষণ হল মোরগ লড়াই।ফাঁকা মাঠে বাজি রেখে দুই পক্ষ মোরগ নিয়ে লড়াইয়ে নামে;চারিদিকে ভিড় জমে যায় তা দেখার জন‍্য।পৌষ সংক্রান্তির দিন সকালে টিউশান পড়ে আসার পথে ,অনেকবার সাইকেল থামিয়ে মোরগ লড়াই দেখেছি।
বিভিন্ন এলাকায় টুসু পরব বা মকর পরব উপলক্ষ্যে, পূর্ব নির্ধারিত ভিন্ন ভিন্ন দিনে স্থানীয় মেলা বসে।কোথাও বা মাটির তৈরী হাতি ,ঘোড়া দিয়ে পুজো হয়,কোথাও বা হয় বনদেবীর পুজো।কাঁসাই নদীর তীরে অবস্থিত আমার মামার বাড়িতে কোনো বছর সংক্রান্তিতে গেলে, দুপুরে খেয়েই সবার সঙ্গে হাঁটতে হ়াঁটতে বেরিয়ে পড়তাম মেলা দেখতে। মেদিনীপুর শহরের অদূরেই গোপগড় সংলগ্ন গোপ কলেজের ক‍্যাম্পাসে আজও প্রতি বছর ১লা মাঘ বনদেবীর পুজো হয় ও মেলা বসে।
নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত আমি স্কুটি নিয়ে ছুটে যাই । এবছরও গেলাম মেয়েকে নিয়ে।দেখলাম ,করোনাজনিত পরিস্থিতির কারণে মেলা বন্ধ আছে ;পুজো হয়েছে যথারীতি।
এ বছর এই স্থানীয় মেলাগুলোর অনুমতি না মেলায় ,সারাবছর অপেক্ষায় থাকা কিছু মানুষের রুজি রোজগার বন্ধ হয়েছে জেনে,মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ফেরার পথে আমার ছোটোবেলার পৌষ পার্বনের সব স্মৃতি মনে করে ,গুনগুন করতে করতে এলাম ….
“পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন
ফিরে আর আসবে কি কখনো…”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।